ইলিশ শিকারে নিষেধাজ্ঞা
বাস্তবায়নে যত প্রতিবন্ধকতা
প্রথম দিকে নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করতে নদীতে অভিযান থাকলেও দু-চার দিন পর তাতে শিথিলতা আসে।
ইলিশের প্রজনন নির্বিঘ্ন করতে ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা শেষ হয়েছে সোমবার মধ্যরাতে। মৎস্য বিভাগের কর্মকর্তারা এই কার্যক্রমের সফলতার দাবি করেছেন। তবে এ সময়ে বেশ কিছু স্থানে নানা কৌশলে ইলিশ ধরা হয়েছে।
মা ইলিশ নিধনের কারণে উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ সম্পর্কে ওয়ার্ল্ডফিশের ইকোফিশ-২ প্রকল্পের ইলিশবিষয়ক বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা জলিলুর রহমান বলেন, ‘এবার জেলেদের মধ্যে নিষেধাজ্ঞা না মানার প্রবণতা দেখা গেছে। যে যেভাবে সুযোগ পেয়েছেন, মা মাছ ধরেছেন। ভবিষ্যতে আমাদের লক্ষ্যমাত্রা ৭ লাখ মেট্রিক টন ইলিশ। সে ক্ষেত্রে ৭০ টন মা মাছের প্রয়োজন। এবার সেই লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে কি না, সংশয় আছে। তবে এখন জাটকা রক্ষার ব্যাপারে আমাদের অধিক যত্নশীল হতে হবে। এখানে শৈথিল্য থাকলে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ দুরূহ হবে।’
এবার জেলেদের মধ্যে নিষেধাজ্ঞা না মানার প্রবণতা দেখা গেছে। যে যেভাবে সুযোগ পেয়েছেন, মা মাছ ধরেছেন। এখন জাটকা রক্ষার ব্যাপারে আমাদের অধিক যত্নশীল হতে হবে।জলিলুর রহমান, ইলিশবিষয়ক বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, ওয়ার্ল্ডফিশের ইকোফিশ-২ প্রকল্প
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পদ্মা নদীর ৭০ কিলোমিটার, শরীয়তপুরের নড়িয়া, সোমেশ্বরঘাট, চাঁদপুর-সংলগ্ন মেঘনার হাইমচর, বরিশালের হিজলা, মুলাদী মেহেন্দীগঞ্জ-সংলগ্ন মেঘনা, এর শাখানদী ভোলার তেঁতুলিয়া, মেঘনাসহ বেশ কিছু এলাকায় জেলেরা নিষেধাজ্ঞার সময়ে মা ইলিশ ধরেছেন। ইলিশ বিক্রির জন্য রীতিমতো হাট পর্যন্ত বসেছিল সংশ্লিষ্ট এলাকায়। এসব এলাকায় অভিযান চালাতে গিয়ে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী হামলার শিকার হয়েছে।
অভিযোগ উঠেছে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কতিপয় নেতার ছত্রচ্ছায়ায় শত শত মৌসুমি জেলে নৌকা নিয়ে ছোট ও বড় ফাঁসের জাল দিয়ে প্রতিদিন মা ইলিশ ধরেছেন। প্রথম দিকে নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করতে নদীতে অভিযান থাকলেও দু-চার দিন পর তাতে শিথিলতা আসে। প্রভাবশালীদের পৃষ্ঠপোষকতায় জেলেদের মারমুখী আচরণে অভিযানে শিথিলতা আনতে বাধ্য হন মৎস্য বিভাগের কর্মকর্তারা।
তবে দক্ষিণের নদ-নদী, বিশেষ করে পায়রা, বিষখালী, বলেশ্বর, কীর্তনখোলা, রামনাবাদ, আগুনমুখা, লোহালিয়া নদীতে ভালোভাবে নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হয়েছে।
বরিশালের মুলাদী উপজেলার কয়েকজন জেলে বলেন, এবার ভিন্ন কৌশলে মৌসুমি জেলেরা মা ইলিশ ধরেছে। এ জন্য তারা শিশুদের ব্যবহারও করেছে। ফোন করলে জেলেরাই ক্রেতাদের কাছে মাছ পৌঁছে দিয়েছেন। এ ছাড়া প্রশাসনের অভিযানের ট্রলারের চালকের সঙ্গে সখ্য গড়ে জেলেরা নির্বিঘ্নে মাছ ধরেছেন।
মৎস্য বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, মুলাদী উপজেলায় তালিকাভুক্ত জেলে রয়েছেন ছয় হাজার। কিন্তু এবার নিষেধাজ্ঞার সময় জেলের সংখ্যা তিন গুণের বেশি বেড়ে গেছে।
মুলাদীর চরমালিয়া গ্রামের কালাম দেওয়ান বলেন, এবার নতুন কৌশলে মা ইলিশ শিকার করেছেন জেলেরা। চরাঞ্চলে অনেক বাড়িতে ডিপ ফ্রিজ কিনে ইলিশ মজুত করা হয়েছে। এমনকি বরফ দিয়ে মাটির নিচে অনেকে মাছ লুকিয়ে সংরক্ষণ করেছেন।
চাঁদপুর মৎস্যজীবী লীগের সাধারণ সম্পাদক মানিক মিয়া দেওয়ান প্রথম আলোকে বলেন, হিজলার গৌরবদি ইউনিয়নের পূর্ব পাড়ে মেঘনা নদীতে জানপুর নামে একটি শাখা খাল রয়েছে। এটি পূর্ব দিকে চাঁদপুরের হাইমচরের নীলকমল ইউনিয়নে এলেকমেন খাল নামে পরিচিত। এই খালে রাতে ইলিশ শিকারের জন্য নোঙর করে থাকত অন্তত ৩০০ নৌকা। এখানকার জেলেদের নেতৃত্ব দিয়েছেন নীলকমল ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) এক সদস্য।
মানিক মিয়া ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়নে এবারের মতো এত শিথিলতা আর আগে কখনো দেখিনি। দিন-রাত প্রকাশ্যে শত শত নৌকায় মা ইলিশ ধরা হয়েছে।’
তবে এসব বিচ্ছিন্ন ঘটনা বাদ দিলে এবারের অভিযান ৯০ ভাগ সফল হয়েছে বলে মনে করেন বরিশাল বিভাগীয় মৎস্য বিভাগের উপপরিচালক আনিছুর রহমান তালুকদার।
তিনি গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে বলেন, ‘এসব এলাকায় প্রতিবছরই এমনটা ঘটে। আমাদের শৈথিল্য ছিল না।’
আনিছুর রহমান তালুকদার বলেন, এবার ইলিশ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ৬ লাখ মেট্রিক টন। এর মধ্যে বরিশাল বিভাগের লক্ষ্যমাত্রা ৪ লাখ মেট্রিক টন। এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হওয়ার ব্যাপারেও আশাবাদী তিনি।
চাঁদপুরে অবস্থিত বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আনিছুর রহমান বলেন, ১ নভেম্বর থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত ৮ মাস জাটকা ধরায় নিষেধাজ্ঞা শুরু হবে। এটা যথাযথভাবে প্রতিপালন করতে হবে। বিশেষ করে ১ মার্চ থেকে ৩০ এপ্রিল এই দুই মাস জাটকার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই সময় জাটকা ১২-১৬ সেন্টিমিটার হয়। এ সময় এরা সাগরে ফিরে যায়।