‘বাড়িত পানি, কাম নাই, খাবারের সমস্যা’

বন্যায় প্লাবিত হয়েছে নিচু এলাকা। রোববার কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের মশালের চরে
ছবি: প্রথম আলো

‘বাইস্যা (বর্ষ) মাস, বাড়িত পানি উঠছে, কাম নাই, বইসা আছি। খাবারের সমস্যা। ঋণ কইরা চলতাইছি।’ নৌকা দেখে ছেলেকে কোলে নিয়ে হাঁটুসমান পানি পেরিয়ে এসে এ কথা বলেন রবিচাঁদ। গতকাল রোববার বেলা তিনটার দিকে কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের ব্রহ্মপুত্র নদের মধ্যবর্তী পশ্চিম মশালের চরে কথা হয় রবিচাঁদের সঙ্গে।

দিনমজুর রবিচাঁদ বলেন, ‘২০ দিন থ্যাইকা পানি বাড়ে আবার কমে। কাইল কম আছিল। আজ ম্যালা বাড়ছে। চরের মানুষ ঢাকা, টাঙ্গাইল ও সিরাজগঞ্জে ধান কাটা, গাড়া ও মাড়াইয়ের কাম করে। আবার কেউ কেউ রিকশাও চালায়। করোনার কারণে এইবার সবাই বাড়িতে বইসা আছে। কোনো কাম নাই। খুব কষ্টে চলতেয়াছি।’

আজ সোমবার সকালে কুড়িগ্রাম মোগলবাসা ঘাট থেকে নৌকায় ধরলা নদী ও ব্রহ্মপুত্র নদের অববাহিকার বিভিন্ন গ্রাম ও চরাঞ্চলে গিয়ে দেখা যায়, নিচু এলাকাগুলো পানিতে ডুবে আছে। ধরলা নদীর তীরবর্তী কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার পাঁচগাছি, মোগলবাসা ও বেগমগঞ্জ ইউনিয়ন পর্যন্ত কয়েক শ বিঘা পটোল ও মরিচখেত বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়েছে। অনেক গাছ দীর্ঘ সময় পানিতে থেকে পচে গেছে। কিছু কিছু নিচু বাড়িতে পানি প্রবেশ করেছে। সড়কগুলো ডুবে আছে। এখন ডিঙিই চলাচলের একমাত্র বাহন। বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের সরকারপাড়া গ্রামের কৃষক সোবাদ আলী বলেন, ‘এবার পটোল ভালো হইছিল। দামও ভালো পাইছি। বন্যায় সব শ্যাষ হইয়া গেল।’

কালিগঞ্জ, মোল্লারহাট, বালাডোবা, সরকারপাড়া, আমিনবাজার, ব্যাপারীপাড়া, মিয়াজিপাড়ায় গিয়ে দেখা যায়, ব্যাপক নদীভাঙন। ধরলা ও ব্রহ্মপুত্রের স্রোতের তোড়ে পাড় ভেঙে পড়ছে। মোল্লাহাট অর্ধেক নদীতে চলে গেছে। মানুষ ঘরবাড়ি সরিয়ে নিচ্ছে। বাড়ি সরাচ্ছেন সৈয়দ কসাই, সাহাব মিস্ত্রি ও দিদার ইসলাম। এক সপ্তাহে বাড়ি ভেঙেছেন বাহাদুর ইসলাম, আবুল হোসেন, জব্বার আলীসহ বেশ কয়েকজন। এলাকার বাসিন্দা সাহাব উদ্দিন বললেন, দুই মাসে দেড় শতাধিক বাড়ি ভেঙে গেছে। তাঁরা উত্তরে একটি চরে আশ্রয় নিয়েছেন। সেখানেও পানি উঠেছে।

ব্রহ্মপুত্র নদের মধ্যখানে পূর্ব বালাডোবা, পূর্ব ও পশ্চিম মশালের চর। বালাডোবার আছর উদ্দিন, মো. রফিক, হাছেন মণ্ডল, সমশের আলীসহ বেশ কয়েকজনের বাড়িতে কোমরপানি। হাছেন মণ্ডল বলেন, খুব কষ্টে আছেন।

বন্যায় প্লাবিত হয়েছে নিচু এলাকার বাড়িঘর। রোববার কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের মশালের চরে
ছবি: প্রথম আলো

মশালের চরের চরদিকে কাশবনে ঘেরা। বাইরে থেকে বোঝার কোনো উপায় নেই ভেতরে আড়াই শ পরিবারের বসবাস। কাশবন ভেদ করে নৌকা নিয়ে দেখা যায়, চরটি ডুবে আছে। কিছু কিছু বাড়িতে হাঁটু ও কোমরসমান পানি উঠেছে। নৌকা দেখে এগিয়ে আসেন বৃদ্ধ রোমেচা বেগম। তাঁর স্বামী মৃত নাগর মণ্ডল। একমাত্র সন্তান রফিকুল ইসলাম বললেন, ‘মোল্লাহাট থাইকা চাউল বাকি আইনা কোনো রকমে চলতাইছি।’

শাহিনুর বেগম নামের এক নারী নৌকার কাছে এসে বলেন, ‘ভাই দেখেন বাড়িতে পানি। স্বামী ঢাকায় রিকশা চালায়। লকলাউনের সময় বাড়িতে আইছে। মাছ মাইরা কোনো রকমে চলতাছিলাম। পানি বাড়ায় এক মাস থাইকা বেকার। হাওলাদ কইরা চলমু, সেই উপায়ও নাই। চরে সবাই গরিব, কার কাছে নিমু হাওলাদ।’

পূর্ব মশালের চরের অন্তঃসত্ত্বা গৃহবধূ আমিনা বেগম বলেন, ‘চরে কোনো ডাক্তার নাই। বেশি কষ্ট হইলে মোল্লারহাট যাই, তা নাহলে কুড়িগ্রাম। যাইতে দুই ঘণ্টা লাগে। নৌকা ছাড়া কোনো উপায় নাই। গরিব মানুষ, খাবার জোটে না। কষ্ট হইলে মুখ বুইজা থাকি।’

ধরলা নদী সেতু পয়েন্টে ৩৪ সেন্টিমিটার ও ব্রহ্মপুত্র চিলমারী পয়েন্টে ২৩ সেন্টিমিটার বিপৎসীমার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। তবে ভাঙন কিছুটা কমেছে।
মো. আরিফুল ইসলাম, কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী

বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বেলাল হোসেন বলেন, দুই নদ–নদী মাঝখানে হওয়ায় ইউনিয়নবাসীর দুর্ভোগ বেড়েছে। একদিকে নদীভাঙন, অন্যদিকে মানুষ পানিবন্দী। এখন পর্যন্ত কোনো ত্রাণ পাওয়া যায়নি। মানুষের অবস্থা খারাপ।

রোববার ৫০ মেট্রিক টন চাল ও ২ লাখ টাকা বরাদ্দ পাওয়া গেছে বলে জানান উলিপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) মো. মাহবুবুর রহমান। তিনি বলেন, এসব দ্রুত বণ্টন করা হবে।

জেলা ত্রাণ কর্মকর্তা মো. আবদুল হাই বলেন, ২৮০ মেট্রিন চাল ও ১৮ লাখ টাকা বরাদ্দ পাওয়া গেছে। তা ইতিমধ্যে বণ্টন করা হয়েছে।

সোমবার দুপুরে কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আরিফুল ইসলাম বলেন, ধরলা নদী সেতু পয়েন্টে ৩৪ সেন্টিমিটার ও ব্রহ্মপুত্র চিলমারী পয়েন্টে ২৩ সেন্টিমিটার বিপৎসীমার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। তবে ভাঙন কিছুটা কমেছে।