বিদ্যালয়ের পাঠদান চলে দুই স্থানে

প্রধান শিক্ষক বিদ্যালয়ের ঘর ভেঙে নদের পশ্চিমে তাঁর বাড়ির পাশে নিয়ে যান। আর সহকারী শিক্ষকেরা নদের পূর্ব পাশে ঘর তুলে ক্লাস নিচ্ছেন।

কুড়িগ্রামের মোহনগঞ্জ ইউনিয়নের তারাবর মৌজার ভেলামারীর চরে চলছে বিদ্যালয়ের পাঠদান
ছবি : প্রথম আলো

কুড়িগ্রামের চর রাজীবপুর উপজেলার শংকর মাধবপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠদান চলে দুই জায়গায়। ব্রহ্মপুত্র নদের ভাঙনের ঝুঁকিতে থাকায় সম্প্রতি কাউকে কিছু না জানিয়ে প্রধান শিক্ষক বিদ্যালয়ের ঘর ভেঙে নদের পশ্চিমে তাঁর বাড়ির পাশে নিয়ে যান। কিন্তু সহকারী শিক্ষকেরা নদের পূর্ব পাশে ঘর তুলে পৃথকভাবে পাঠদান করছেন। এ দুই জায়গার দূরত্ব চার কিলোমিটার।

গত মঙ্গলবার কোদালকাটি ইউনিয়নের শংকর মাধবপুরের বিলপাড়া এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, একটি ঘরে তিনজন সহকারী শিক্ষক অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থীকে পড়াচ্ছেন। স্থানীয় লোকজন, শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শংকর মাধবপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বর্তমানে শিক্ষার্থীসংখ্যা ৩৫০। বিদ্যালয়ে শিক্ষকের আটটি পদের বিপরীতে সাতজন কর্মরত আছেন। তবে তাঁদের মধ্যে তিনজন প্রশিক্ষণে।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯ সালে বিদ্যালয়টি ব্রহ্মপুত্র নদের ভাঙনের ঝুঁকিতে পড়ে। নদ বিদ্যালয়ের খুব কাছে চলে এলে প্রধান শিক্ষক (ভারপ্রাপ্ত) রফিকুল ইসলাম গত ১৩ মার্চ উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে লিখিত আবেদন করেন বিদ্যালয়টি নদের পশ্চিম পারে স্থানান্তর করার জন্য। অনুমতি পাওয়ার আগেই হঠাৎ করে প্রধান শিক্ষক ৮ এপ্রিল রাতের অন্ধকারে বিদ্যালয়ের ঘর ভেঙে নিজ এলাকায় নিয়ে যান। এটি ব্রহ্মপুত্র নদের পশ্চিম পারে মোহনগঞ্জ ইউনিয়নের তারাবর মৌজার ভেলামারীর চরে। কিন্তু সহকারী শিক্ষকেরা নদ পার হয়ে চার কিলোমিটার দূরে না গিয়ে বিদ্যালয়ের কাছাকাছি নদের পূর্ব পারে ঘনবসতিপূর্ণ শংকর মাধবপুরের বিলপাড়ায় শিক্ষার্থীদের ক্লাস করাচ্ছেন। বিদ্যালয় নিয়ে টানাটানিতে ক্ষুব্ধ শংকর মাধবপুর এলাকার শতাধিক শিক্ষার্থী, অভিভাবক,শিক্ষক ও এলাকাবাসী। তাঁরা নদের পূর্ব পারে শংকর মাধবপুরেই বিদ্যালয়টি রাখার পক্ষে।

সহকারী শিক্ষক কল্পনা খাতুন, নজরুল ইসলাম, গোলাপি খাতুন অভিযোগ করে বলেন, প্রধান শিক্ষক বিদ্যালয়ের মালামাল আত্মসাৎ করেছেন। কাজ না করেই ভুয়া বিল ভাউচার দেখিয়ে সরকারি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। এসব অপকর্ম ঢাকতে প্রধান শিক্ষক তাঁর স্ত্রীকে বানিয়েছেন বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি। তাঁদের অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত অভিযোগ দেওয়া হলেও কাজ হয়নি।

শিক্ষকেরা আরও বলেন, এপ্রিল মাসে কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়াই বিদ্যালয়ের একটি টিনশেড ঘর, লোহার অ্যাঙ্গেলসহ তিন লক্ষাধিক টাকার মালামাল নিয়ে যান প্রধান শিক্ষক। অথচ নদের পশ্চিম পাশে ছাত্র-ছাত্রী তেমন নেই। এ অবস্থায় তাঁরা উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার পরামর্শে বিলপাড়া এলাকায় ক্লাস করাচ্ছেন।

সেখান থেকে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় চার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে মোহনগঞ্জ ইউনিয়নের ভেলামারী এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, একটি ঘরের ভেতরে ১০-১২ জন শিক্ষার্থী খেলাধুলা করছে। কোনো শিক্ষক নেই। কিছুক্ষণ পর সেখানে আসেন প্রধান শিক্ষক রফিকুল ইসলাম। দুর্গম এ চরের আশপাশে ১০-১৫টি বসতবাড়ি ছাড়া কিছুই নেই।

রফিকুল ইসলাম বলেন, সহকারী শিক্ষকেরা এ দুর্গম এলাকায় আসতে চান না। এ কারণে তাঁরা দ্বিমত করছেন। অর্থ আত্মসাতের অভিযোগটি সত্য নয়। উল্টো তিনি বিদ্যালয়ের জন্য কয়েক লাখ টাকা ব্যক্তিগত তহবিল থেকে খরচ করেছেন।

বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি ফারজানা খাতুন বলেন, পূর্ব পারে যাতায়াতব্যবস্থা ভালো হওয়ায় আশপাশে বেশ কিছু বিদ্যালয় আছে। কিন্তু পশ্চিম পাশে কোনো বিদ্যালয় নেই। তাই তাঁরা তাঁদের বিদ্যালয়টিকে পশ্চিম পারে নিতে চান।

রাজীবপুর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ফরহাদ হোসেন বলেন, দুই জায়গায় ক্লাস চলার বিষয়ে তিনি জানেন। উপজেলা শিক্ষা কমিটি এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেবেন।

উপজেলা শিক্ষা কমিটির সভাপতি ও উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আকবর হোসেন বলেন, সভায় আলোচনা করে বিষয়টির সমাধান করা হবে।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা অমিত চক্রবর্ত্তী বলেন, বিদ্যালয়টি ভাঙনের ঝুঁকিতে ছিল। বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক বিদ্যালয়ের ঘর ভেঙে পাশের একটি জায়গায় নিয়ে গেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। বিদ্যালয় কোথায় হবে, তা সভায় আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।