সিলেটের ওসমানীনগর উপজেলায় টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজ স্থাপনের জন্য তিন একর জমি দরকার। এলাকাবাসী বিনা মূল্যে প্রায় দ্বিগুণ জমি দিতে প্রস্তুত। কিন্তু বিনা মূল্যের জমি না নিয়ে কয়েক কোটি টাকা ব্যয়ে জমি অধিগ্রহণের কথা ভাবা হচ্ছে। এর জন্য আওয়ামী লীগের স্থানীয় এক নেতা সেখানে ৬০ শতক জমিও কিনেছেন। পুরো বিষয়টি করা হচ্ছে একটি ‘সিন্ডিকেটে’র মাধ্যমে। যার সঙ্গে আওয়ামী লীগ ও ভূমি ব্যবসায়ীরা জড়িত বলে অভিযোগ করেছেন গণফোরামের স্থানীয় সাংসদ মোকাব্বির খান।
সাংসদের অভিযোগ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জায়গা অধিগ্রহণ নিয়ে সিন্ডিকেট করে সরকারের প্রায় ১০ কোটি টাকা লুটপাটের প্রস্তুতি চলছে। সম্প্রতি সাংসদের সংবাদ সম্মেলনের পর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আফজালুর রহমান চৌধুরী পাল্টা সংবাদ সম্মেলন করে সাংসদকে ভর্ৎসনা করেন।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য এলাকাবাসী যেখানে বিনা মূল্যে জমি দিতে চেয়েছেন, সে জায়গাটি ঢাকা–সিলেট মহাসড়কের পাশেই ভাগলপুর এলাকায়। সেখানে জমি না নিয়ে মহাসড়ক থেকে দূরে জনবসতিপূর্ণ এলাকা গ্রামতলায় জমি অধিগ্রহণের চিন্তা চলছে। এ অবস্থায় সরকারের ভূমি অধিগ্রহণের প্রস্তাবিত স্থান গ্রামতলা থেকে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. আফজালুর রহমান চৌধুরী ৬০ শতক জমি কিনেছেন। জমি কেনার পর অভিযোগ উঠেছে, ৬০ শতক জমি কিনে একটি আবাসন কোম্পানির অবিক্রীত ৩০০ শতক জমি সরকারিভাবে অধিগ্রহণের তোড়জোড় করছেন এই নেতা। তাঁর সঙ্গে আওয়ামী লীগের স্থানীয় কয়েক নেতাসহ ভূমি ব্যবসায়ীদের ‘সিন্ডিকেট’ রয়েছে। আওয়ামী লীগের নেতা জমি কেনার বিষয়টি স্বীকার করলেও সিন্ডিকেট করার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন।
ঢাকা-সিলেট মহাসড়ককেন্দ্রিক একটি উপজেলা ওসমানীনগর। মহাসড়কের প্রায় ২৫ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে এই উপজেলা। যোগাযোগ সুবিধায় প্রশাসনিক অবকাঠামোগুলো সব মহাসড়ককেন্দ্রিক। এর মধ্যে ব্যতিক্রম শুধু টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজ স্থাপন প্রকল্পের জন্য অধিগ্রহণের প্রস্তাবিত স্থানটি।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের অধীন এ প্রকল্পের জমিপ্রাপ্তির ‘নিশ্চয়তাপত্রে’ উল্লেখ রয়েছে, সর্বোচ্চ তিন একর জমি অধিগ্রহণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে পাঁচটি অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। প্রথম অগ্রাধিকার হচ্ছে, খাস অথবা অব্যবহৃত জমি অধিগ্রহণ। বিকল্প হিসেবে সর্বশেষ চার নম্বর অগ্রাধিকারে বলা হয়, উপজেলা সদরের নিকটবর্তী ও যাতায়াত উপযোগী জায়গা। জমি অধিগ্রহণের এক নম্বর অগ্রাধিকার ফেলে সর্বশেষ অগ্রাধিকারকে গ্রহণ করে উপজেলা প্রশাসন।
ঢাকা-সিলেট মহাসড়ককেন্দ্রিক একটি উপজেলা ওসমানীনগর। মহাসড়কের প্রায় ২৫ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে এই উপজেলা। যোগাযোগ সুবিধায় প্রশাসনিক অবকাঠামোগুলো সব মহাসড়ককেন্দ্রিক। এর মধ্যে ব্যতিক্রম শুধু টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজ স্থাপন প্রকল্পের জন্য অধিগ্রহণের প্রস্তাবিত স্থানটি।
অধিগ্রহণসংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রথম অগ্রাধিকার পাওয়া জায়গাটি উপজেলা সদর থেকে প্রায় ৯ কিলোমিটার দূরে। এ জন্য নিকটবর্তী জায়গা হিসেবে গোয়ালাবাজার ইউনিয়নের গ্রামতলায় ব্যক্তিমালিকানাধীন আবাসন কোম্পানির জায়গায় প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে বর্তমান বাজারদর অনুযায়ী ৩০০ শতক জায়গা কিনে অধিগ্রহণে সরকারের প্রায় ১০ কোটি টাকা ব্যয়ের বিষয়টিও তুলে ধরা হয়। অপর দিকে বিনা মূল্যে জমি দেওয়ার প্রস্তাবের জায়গাটির অবস্থান মহাসড়ক লাগোয়া। কাগজপুর সেতুর পাশে ভাগলপুর এলাকার রাস্তার পাশে গোয়ালাবাজার ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত। ওসমানীনগর উপজেলারও মধ্যবর্তী স্থান এটি। ব্যক্তিমালিকানাধীন এই জায়গা পঞ্চায়েত কমিটির অধীনে থাকলেও অব্যবহৃত অবস্থায় রয়েছে। পঞ্চায়েত কমিটির লোকজনই জানিয়েছেন, জায়গা যেহেতু অব্যবহৃত, বিনা মূল্যে সরকারকে দিতে তাঁরা একমত আছেন।
জানতে চাইলে সিলেটের জেলা প্রশাসক এম কাজী এমদাদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ওসমানীনগরে জমি অধিগ্রহণ কাজটি মাত্র প্রথম ধাপে আছে। এরপর আরও অনেক ধাপ রয়েছে। একটি জায়গা অধিগ্রহণ চূড়ান্ত করার আগে অনেক যাচাই-বাছাই হয়। এর মধ্যে যদি কোনো ত্রুটি থাকে, সেটা অবশ্যই দেখা হয়। কিন্তু শুরুর আগেই সিন্ডিকেট বলা হচ্ছে। এরপরও পুরো বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।
৬ জুন সরেজমিনে গোয়ালাবাজারের বাসিন্দা কয়েকজন প্রবীণ ব্যক্তি জানিয়েছেন, যেখানে সরকারের প্রায় সব কাঠামো মহাসড়কের সঙ্গে সরাসরি সংযোগ রেখে হচ্ছে, সেখানে গ্রামের ভেতর একটি আবাসন কোম্পানির স্থানটি কেন টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজ স্থাপনের জন্য বেছে নেওয়া হয়েছে, সেটি অনেকটা গোপন ছিল। অধিগ্রহণ প্রক্রিয়ার মধ্যে থাকা সেখানকার কিছু জমি ওসমানীনগর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. আফজালুর রহমান চৌধুরী কেনার পর বিষয়টি প্রকাশ পায়।
গ্রামতলায় গিয়ে দেখা গেছে, চারদিকে গ্রামের বসতবাড়ি, মাঝখানে ফাঁকা জায়গা। সেখানে খুঁটি পুঁতে প্লট চিহ্নিত করা। ২০০৫ সালে এই আবাসন কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করা হয়। কিন্তু কোনো প্লট কেনাবেচা হয়নি। আবাসিক এলাকায় কোনো স্থাপনাও নেই। আবাসন কোম্পানির অবিক্রীত জমি কেনাবেচা না হওয়ায় এই জায়গা অধিগ্রহণের মাধ্যমে মূলত বিক্রি করতেই স্থান প্রস্তাব করা হয়েছে।
ওসমানীনগরে জমি অধিগ্রহণ কাজটি মাত্র প্রথম ধাপে আছে। এরপর আরও অনেক ধাপ রয়েছে। একটি জায়গা অধিগ্রহণ চূড়ান্ত করার আগে অনেক যাচাই-বাছাই হয়। এর মধ্যে যদি কোনো ত্রুটি থাকে, সেটা অবশ্যই দেখা হয়। কিন্তু শুরুর আগেই সিন্ডিকেট বলা হচ্ছে। এরপরও পুরো বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।এম কাজী এমদাদুল ইসলাম, জেলা প্রশাসক, সিলেট
সেখানকার কয়েকজন স্থায়ী বাসিন্দা বলছেন, আবাসনের এই জায়গায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান করতে হলে সবার আগে মহাসড়কের সঙ্গে সংযোগ করা রাস্তা বড় করতে হবে। এতে করে অন্তত তিন শতাধিক বসতবাড়ির জায়গাও অধিগ্রহণ করতে হবে। আবাসনের মালিকপক্ষের একজন মো. ছাবু মিয়া। তাঁর মুঠোফোনে কল দিলে তাঁর বড় ভাই আবু মিয়া ফোন ধরেন। তিনি জানান, এই আবাসন ব্যবসায় নেমে ঋণগ্রস্ত তাঁর ভাই। প্লট আকারে নয়, ঋণ শোধ করতে একসঙ্গে বিক্রি করার চেষ্টায় আছেন। সম্প্রতি কয়েকজনের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা হয়েছে। তবে এঁরা কারা, বলতে চাননি আবু মিয়া।
ওসমানীনগরের তাজপুর সাব-রেজিস্ট্রার কার্যালয় থেকে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, মো. ছাবু মিয়ার কাছ থেকে সম্প্রতি আওয়ামী লীগ নেতা আফজালুর রহমান চৌধুরী, মো. ফয়ছল আহমদ ও মো. জাকির হোসেন নামের তিনজন ৬০ শতক জায়গা কেনার দলিল সম্পাদন করেন। গত ৫ জানুয়ারি সম্পাদিত জমি কেনাবেচার দলিলে (নম্বর ৩৩/২০২১) দেখা গেছে, আফজালুর সাড়ে ২৭ শতক, মো. ফয়ছল আহমদ ৩০ শতক ও মো. জাকির আহমদ আড়াই শতক জায়গা মো. ছাবু মিয়ার কাছ থেকে কিনেছেন। দলিলে জমির শ্রেণি ‘বরুন্ডী ও স্থাপনাবিহীন ও পুকুর’ উল্লেখ করা। ৬০ শতক জমির মূল্য ৯০ লাখ ৪০ হাজার টাকা।
অধিগ্রহণ প্রক্রিয়ায় থাকা জমি কেনাবেচায় আফজালুরের দালিলিক প্রমাণ থাকায় সাংসদ মোকাব্বিরের ‘সিন্ডিকেট’ তকমা এখন তাঁর কাঁধে পড়েছে বলে আওয়ামী লীগের নেতারাই বলছেন। অভিযোগ উঠেছে, স্থানীয় প্রশাসনকে তিনি প্রভাবিত করে আবাসনের জায়গাটি টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজের প্রস্তাবিত স্থান হিসেবে নির্ধারণ করার পর জায়গার কিছু অংশ ক্রয় করে পুরো আবাসনের কর্তৃত্ব নিয়েছেন। অধিগ্রহণের প্রজ্ঞাপন জারি হলে আবাসনের পুরো ৩০০ শতক জায়গা তাঁর কেনা জায়গার দলিলের মূল্য অনুযায়ী অন্তত তিন গুণ টাকা পাবেন।
মো. আফজালুর রহমান চৌধুরী আবাসন কোম্পানির জায়গা কেনার বিষয়টি প্রথম আলোর কাছে স্বীকার করেন। তিনি দাবি করেন, এই জায়গা টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজের জন্য অধিগ্রহণ করা হবে, এ বিষয়টি না জেনেই তিনি কিনেছেন। আফজালুর বলেন, ‘উপজেলা সদরের নিকটবর্তী স্থানে টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজের ভূমি অধিগ্রহণ করার সরকরি নির্দেশনা রয়েছে। উপজেলা প্রশাসন এই নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে চায়। কিন্তু এর থেকে ৯ কিলোমিটার দূরে একটি জায়গা বিনা মূল্যে দেওয়ার প্রস্তাব করে সাংসদ অযথা সরকারি উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত করছেন।’
অধিগ্রহণ প্রস্তাবের জায়গা থেকে জমি কেনায় দলের ভেতর বিরূপ প্রতিক্রিয়া হচ্ছে জানিয়েছেন ওসমানীনগরের প্রবীণ রাজনীতিবিদ, উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আতাউর রহমান। তিনি বলেন, ‘সিন্ডিকেট বিষয়টি এখন ঠাকুর ঘরে কে রে/ আমি কলা খাই না...প্রবাদের মতো হয়ে গেছে। আমাদের সেক্রেটারি (আফজালুর) ডাইরেক্ট ও ইনডাইরেক্ট ইনভলব ওই চক্রে। টেননিক্যাল স্কুল করতে গিয়ে এমপি সাহেব তো সরকরের টাকা বাঁচাতে চেয়েছেন। এখানে তো দ্বিমত করার কোনো সুযোগ নেই। এ ব্যাপারটির তদন্ত হওয়া প্রয়োজন।’
কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তর সূত্র জানায়, প্রকল্প পরিচালকের দপ্তর থেকে গত ১২ জানুয়ারি ‘ভূমি নির্বাচন প্রসঙ্গে’ একটি চিঠি দেওয়া হয় প্রশাসনকে। চিঠিতে স্থানীয় সাংসদের বরাত দিয়ে বলা হয়, ‘যেহেতু এলাকার জনগণ বিনা মূল্যে ভূমি প্রদানে অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছেন, স্কুল ও কলেজ নির্মাণের জন্য যথোপুক্ত নির্বাচন করা হলে ভূমি অধিগ্রহণ মূল্য পরিশোধ করতে হবে না, যা প্রকল্পের জন্য অর্থসাশ্রয়ী হবে।’
অধিগ্রহণ প্রস্তাবের জায়গা থেকে জমি কেনায় দলের ভেতর বিরূপ প্রতিক্রিয়া হচ্ছে জানিয়েছেন ওসমানীনগরের প্রবীণ রাজনীতিবিদ, উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আতাউর রহমান।
সর্বশেষ এই চিঠিও সংঘবদ্ধ ভূমি ব্যবসায়ীদের প্রভাবে স্থানীয় প্রশাসন আমলে নেয়নি বলে অভিযোগ সাংসদ মোকাব্বির খানের। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ১০ কোটি টাকা জমি কেনার প্রস্তুতির মধ্যে ২০ কোটি টাকার জমি বিনা মূল্যে দিতে প্রস্তুত এলাকার কিছু মানুষ। কিন্তু রাজনৈতিক প্রভাব আর ভূমি ব্যবসায়ীদের কূটকৌশলে তা হচ্ছে না।