পূর্ব আকাশে ভোরের সূর্য উঁকি দিচ্ছে। নীল আকাশে উড়ছে ঘুড়ি। নির্ভয়ে আকাশে পাখিদের ছুটে চলা। নদীতে ভাসানো মাঝির পালতোলা নৌকা। পাড়ে সাজানো সারি সারি গাছ আর বাড়ি। এই সবই যেন ভয়হীন, বাধাহীন, ভালোবাসায় ঘেরা নতুন পৃথিবীর প্রতীকী রূপ—যে পৃথিবীর স্বপ্ন দেখেছিলেন মানবতার ব্রত নিয়ে এগিয়ে চলা ফারাজ আইয়াজ হোসেন।
বুধবার সাভারের সেন্টার ফর দ্য রিহ্যাবিলিটেশন অব দ্য প্যারালাইজড (সিআরপি) বা পক্ষাঘাতগ্রস্তদের পুনর্বাসন কেন্দ্রে ফারাজ হোসেন ফাউন্ডেশন ও সিআরপির যৌথভাবে আয়োজিত চিত্রাঙ্কন উৎসবে মনের এই ভাবনাগুলোই রং পেনসিলের ছোঁয়ায় আর্ট পেপারে জীবন্ত করে তুলেছে শারীরিক সক্ষমতাহীন ও বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু-কিশোর-কিশোরীরা।
২০১৬ সালের ১ জুলাই ফারাজ আইয়াজ হোসেন গুলশানের হোলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলায় প্রাণ হারান। সাহসিকতা, মানবিকতা ও বন্ধুত্বের অনন্য নিদর্শন এই ফারাজ আইয়াজ হোসেন। শারীরিক সক্ষমতাহীন ও বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু-কিশোর-কিশোরীরাও ফারাজের আত্মত্যাগের প্রতি সম্মান দেখিয়ে নিজেদের দাবি করছে ‘আমরাই ফারাজ’। টি–শার্টের পেছনে ‘উই আর ফারাজ’ দাবি করে চিত্রাঙ্কন উৎসবে অংশ নিয়েছে তারা।
ফারাজের অদম্য সাহসিকতা আজ ছড়িয়ে পড়েছে ওদের মধ্যেও। হাত নেই তুলি সরকারের (১১), তবু থেমে নেই সে। চিত্রাঙ্কন অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে পা দিয়েই এঁকে ফেলেছে সূর্য আর ঘুড়ি। শাহজাদাও (১১) পা দিয়েই এঁকেছে বাড়ি আর গাছ।
মো. রহমত উল্লাহ (১৪), ইশাত হোসেন (১২) ও মামুন শেখ (১২) শারীরিক প্রতিবন্ধকতা নিয়ে অংশ নেয় এ উৎসবে। তাদের রং পেনসিলের ছোঁয়ায় আর্ট পেপারে জীবন্ত হয়ে উঠেছে গাছ, নদী, পাহাড়, পাখিসহ গ্রামীণ জীবনের চিরায়ত সৌন্দর্য।
বুধবার সকাল ১০টায় ফারাজ হোসেন ফাউন্ডেশন ও সিআরপির যৌথভাবে আয়োজিত এ উৎসবে শারীরিক সক্ষমতাহীন ও বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ৯২ জন শিশু-কিশোর-কিশোরী অংশ নেয়। সিআরপির মেরিগোল্ড হাউস ভবনের চতুর্থ তলায় ‘ফারাজ হোসেন সেন্টার’–এ উৎসবের উদ্বোধন করেন ফাউন্ডেশনের সদস্য ও এসকেএফ ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের এজিএম (মার্কেটিং) জাহিদ হোসেন ফয়সাল। সিআরপির ফারাজ হোসেন সেন্টার, উইলিয়াম অ্যান্ড মেরী টেইলর স্কুল এবং রেডওয়ে হল—এ তিনটি স্থানে এ উৎসব হয়। অনুষ্ঠানে এসকেএফের কি-প্রোডাক্ট ম্যানেজার সিফাত সামিয়া, ফারাজ হোসেন ফাউন্ডেশনের ডেপুটি ম্যানেজার তাহমিদ ইবনে মাজহার, সিআরপির উইলিয়াম অ্যান্ড মেরী টেইলর স্কুলের অধ্যক্ষ মো. আবদুল্লাহ আল জুবায়ের, জেনারেল লিয়াজোঁ কর্মকর্তা রহমতুল বারী উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠানে ব্র্যান্ড স্পনসর ছিল এসকেএফের জিংক বি। এর আগে সকাল নয়টায় চিত্রাঙ্কন উৎসবের পাশাপাশি বিশ্ব সেরিব্রাল পালসি দিবস-২০২১ পালন করা হয়। দিবস উপলক্ষে সিআরপির বাস্কেটবল গ্রাউন্ড থেকে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা বের করা হয়। শোভাযাত্রাটি সিআরপির বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে প্রধান কার্যালয়ের সামনে এসে শেষ হয়।
ফারাজ হোসেন ফাউন্ডেশনের সদস্য জাহিদ হোসেন বলেন, ফারাজ ফাউন্ডেশন অবিরাম আর্তদের সেবায় কাজ করছে। ফারাজ হোসেন জীবন দিয়েছিলেন মানবতার জন্য। ফারাজের নামে গড়া ফাউন্ডেশনের সব কার্যক্রমই তাঁর ইচ্ছা ও স্বপ্নের প্রতিফলন। তিনি বলেন, চিত্রাঙ্কন উৎসবে আঁকা ছবিগুলো বিভিন্ন স্থানে প্রদর্শনী ও বিক্রি করা হবে। প্রাপ্ত অর্থ ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে মানবতার কল্যাণে পরবর্তী কার্যক্রমে ব্যয় করা হবে।
সিআরপির নির্বাহী পরিচালক মুহাম্মদ সোহরাব হোসেন বলেন, ‘২০১৮ সাল থেকে ফারাজ হোসেন ফাউন্ডেশনের সঙ্গে আমরা কাজ করছি। ইতিমধ্যে তারা বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের জন্য বিভিন্ন ধরনের সহযোগিতা ও বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে।’ তিনি বলেন, এসব অনুষ্ঠান বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের মানসিক বিকাশে যেমন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে, তেমনি এই শিশুদের নিয়ে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিরও পরিবর্তন আনবে।