বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পেয়েছেন, কিন্তু ভর্তির টাকা নেই দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী সেলিমের

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের তিনটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেয়েও অর্থাভাবে ভর্তি হতে পারছেন না দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মো. সেলিম ভূঞা
প্রথম আলো

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের তিনটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী তরুণ মো. সেলিম ভূঞা (২০)। অথচ টাকা জোগাড় করতে না পারায় কোনো বিশ্ববিদ্যালয়েই ভর্তি হতে পারছেন না তিনি। মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরে সেলিমের আকুতি, ‘এত কষ্ট করে এত দূর আসার পর আমার পড়াশোনা কি থেমে যাবে?’

মো. সেলিম ভূঞার বাড়ি নরসিংদীর রায়পুরার আমীরগঞ্জ ইউনিয়নের হাসনাবাদ গ্রামে। তাঁর বাবা মো. হজরত আলী ভূঞা ও মা গৃহবধূ মাজেদা বেগম। এই দম্পতির চার সন্তানের মধ্যে সেলিম দ্বিতীয়। দিনমজুর বাবা কষ্ট করে সেলিমকে এই পর্যন্ত এনেছেন। তবে সম্প্রতি তিনি অসুস্থ হয়ে বাড়িতে পড়ে আছেন।

সেলিমের পরিবার ও বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০০০ সালের ৬ জুন সেলিমের জন্ম। জন্ম থেকেই দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী তিনি। পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ দেখে দিনমজুর বাবা মো. হজরত আলী ভূঞা তাঁকে অন্য শিশুদের মতোই ছয় বছর বয়সে হাসনাবাদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করে দেন। ২০১২ সালে এই বিদ্যালয় থেকে জিপিএ-৫ পান সেলিম। পরে ২০১৬ সালে হাসনাবাদ উচ্চবিদ্যালয় থেকে জেএসসিতে জিপিএ-৫ ও সাধারণ গ্রেডে বৃত্তি পান। ২০১৮ সালে জিপিএ–৪.২৮ পেয়ে এসএসসি পাস করেন। এরপর উচ্চমাধ্যমিকে পড়তে ভর্তি হন নরসিংদী সরকারি কলেজে। গত বছর মানবিক বিভাগ থেকে জিপিএ–৪.৭৫ পেয়ে এইচএসসি পাস করেন তিনি।

জন্ম থেকেই দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী সেলিম। দিনমজুর বাবা কষ্ট করে তাঁকে এই পর্যন্ত এনেছেন। তবে সম্প্রতি বাবা অসুস্থ হয়ে বাড়িতে পড়ে আছেন। সেলিম বলেন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে অন্তত ১৩ হাজার টাকা দরকার। অথচ তাঁর কাছে কোনো টাকাই নেই।

দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী সেলিম বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই আমার খুব ইচ্ছা আমি মাস্টার্স পাস করে সরকারি চাকরি করব। এ পর্যন্ত বিভিন্ন সময় বিভিন্ন মানুষের সহযোগিতায় আমি পড়াশোনা চালিয়ে এত দূর এসেছি। এবারের গুচ্ছ পদ্ধতির বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছি। আমার ইচ্ছা, আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ব।’

সেলিম আরও বলেন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ১ থেকে ৩ জানুয়ারির মধ্যে মৌখিক পরীক্ষা ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দিতে হবে। কিন্তু তাঁর পরিবারের যা আর্থিক অবস্থা, তাতে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারবেন কি না, তা নিয়ে শঙ্কায় আছেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে অন্তত ১৩ হাজার টাকা দরকার। অথচ তাঁর কাছে কোনো টাকাই নেই।

সেলিম বলেন, ‘আগে বাবা দিনমজুরের কাজ করতেন। এখন তিনি অসুস্থ হয়ে বাড়িতে পড়ে আছেন। কোনো কাজ করার অবস্থায় তিনি নেই। ছোট ভাই রাজমিস্ত্রির কাজ করে কোনো রকমে সংসার চালায়। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি ও পড়াশোনার জন্য কেউ যদি আমার পাশে দাঁড়াতেন, তাহলে আমি পড়াশোনাটা শেষ করতে পারতাম।’

হাসনাবাদ উচ্চবিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষক দীপক কুমার দাস বলেন, ‘শ্রুতলেখকের সহযোগিতা নিয়ে সেলিম এত দূর এসেছে। মেধাবী সেলিম প্রতিটি পরীক্ষায় ভালো ফলও করেছে। এবার সে তিনটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছে। কিন্তু আর্থিক কারণে তার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি ও পড়াশোনা এখন শঙ্কার মধ্যে পড়েছে। সমাজে অনেক বিত্তবান মানুষ আছেন, তাঁদের কেউ যদি তার পাশে দাঁড়াতেন, তাহলে সে তার স্বপ্ন পূরণ করতে পারত।’

আমীরগঞ্জ ইউপির প্যানেল চেয়ারম্যান কবির আহমেদ ভূঁইয়া বলেন, ‘আমি সেলিম নামের ওই শিক্ষার্থীকে ব্যক্তিগতভাবে চিনি। সে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেয়েও টাকার অভাবে ভর্তি হতে পারছে না। তার জন্য মানবিক দিক বিবেচনায় আমাদের কিছু করা উচিত। আমরা কতটুকু করতে পারব জানি না, তবে আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টাটুকু করব।’

দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে রায়পুরার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আসগর হোসেন এই প্রতিবেদকের কাছে ঘটনা শুনে বলেন, ‘আমি এই ঘটনা আগে জানতাম না। অর্থাভাবে কারও পড়াশোনা থেমে যাবে, এটা হতে পারে না। আমি মো. সেলিম ভূঞা নামের ওই শিক্ষার্থীর সঙ্গে যোগাযোগ করব। তাঁর জন্য কী করা যায় দেখছি।’