বেগমগঞ্জে করোনাকালের আলো ‘শিখা সংসদ’

নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের ছয়ানী ইউনিয়নে করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তির বাড়িতে অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে যান শিখা সংসদের স্বেচ্ছাসেবীর
ছবি: সংগৃহীত

করোনা মহামারির শুরুতে নোয়াখালীর বিভিন্ন উপজেলায় করোনায় মারা যাওয়া ব্যক্তিদের লাশ দাফনে এগিয়ে আসেননি স্বজনেরা। বাধা দিয়েছেন গ্রামের লোকজন। লাশ দাফন করতে হয়েছে পুলিশ ও প্রশাসনের লোকজনকে। এমন সময়ে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রাম ছয়ানীতে আশার আলো হয়ে দেখা দেয় সামাজিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন শিখা সংসদ।  

মহামারির শুরুতে শিখা সংসদ মাস্ক পরতে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করার পাশাপাশি গ্রামে গ্রামে ঘুরে সুরক্ষাসামগ্রী বিতরণ, মাইকিং করে জনসাধারণকে সচেতন করা, করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তির বাড়িতে খাদ্যসামগ্রী ও বিনা মূল্যে অক্সিজেন সিলিন্ডার পৌঁছে দেওয়ার কাজ করে। এরপর সংগঠনের সদস্যরা লাশ দাফনের দায়িত্বটিও নিজেদের কাঁধে তুলে নেন।

করোনাকালে সংগঠনটির ইতিবাচক কর্মকাণ্ড নজর কাড়ে উপজেলা প্রশাসনের। মহামারির শুরুতে বিধিনিষেধে মানুষের বাড়িতে খাদ্যসামগ্রী পৌঁছে দেওয়াসহ বিভিন্ন কাজে যখন উপজেলা প্রশাসন হিমশিম খাচ্ছিল, তখন সংগঠনটির ২৫ সদস্য স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করার জন্য প্রশাসনের ডাক পান। তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মাহবুব আলমের অনুরোধে তাঁরা প্রশাসনের হয়ে করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তির বাড়িতে কঠোর বিধিনিষেধ কার্যকর করা, খাবার পৌঁছে দেওয়া এবং মানুষকে সচেতন করার কাজ করেন।

শিখা সংসদের জন্ম ১৯৮৩ সালে। ছয়ানী ইউনিয়নের বাসিন্দা মহিউদ্দিনসহ (মারা গেছেন) ২০ থেকে ২৫ জন তরুণ মিলে এটি প্রতিষ্ঠা করেন। শুরু থেকে সংগঠনটি গরিব ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াশোনার করানো, দরিদ্র ঘরের মেয়েদের বিয়ের ব্যবস্থা করা, রাস্তাঘাট সংস্কার, বৃক্ষরোপণ, জাতীয় দিবস পালন, মাদকের বিরুদ্ধে প্রচারসহ নানা কর্মকাণ্ড চালিয়ে আসছে।

সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান (সবুজ) প্রথম আলোকে তিনি বলেন, এই সংগঠনের প্রত্যেক সদস্যের ব্রত সমাজের জন্য, এলাকার মানুষের জন্য কিছু করা। বর্তমানে সংগঠনটির সদস্যসংখ্যা ১৫২। এর মধ্যে নির্বাহী কমিটিতে আছেন ৪১ জন। করোনা মহামারি শুরু হওয়ার পর এই ৪১ জনের মধ্যে ১৭ জন; সাধারণ সদস্য থেকে ৮ জনসহ ২৫ সদস্যের একটি স্বেচ্ছাসেবক দল গঠন করা হয়েছে। দলটি মাঠপর্যায়ে প্রশাসনকে সহায়তা করেছে।

মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, করোনা মহামারির শুরুতে কাজ করতে গিয়ে তাঁরা দেখতে পান, আক্রান্ত ব্যক্তিদের অক্সিজেন–সংকট হয়। এই পরিস্থিতিতে তাঁরা নিজেরাই ছোট-বড় ২০টি অক্সিজেন সিলিন্ডার ও ১০টি অক্সিমিটার সংগ্রহ করেন। এরপর তাঁরা নিজেরাই করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে যাঁদের অক্সিজেনের মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে কম, তাঁদের অক্সিজেন–সুবিধা দেওয়া শুরু করেন। আর যাঁদের অক্সিজেনের মাত্রা বেশি কমে যায়, তাঁদের দ্রুত হাসপাতালে ভর্তির ব্যবস্থা করেন।

এই সংগঠনের সেবা পাওয়া স্থানীয় কালিকাপুর গ্রামের মোহাম্মদ আলী ফারুক বলেন, গত জুন মাসে হঠাৎ তাঁর মা মেহরাজ বেগম (৫২) অসুস্থ হয়ে পড়েন। করোনার সব উপসর্গ দেখা দিয়েছিল তাঁর। একপর্যায়ে দেখেন, তাঁর মায়ের অক্সিজেনের মাত্রা কমে যাচ্ছে। তখন এগিয়ে আসে শিখা সংসদ। সুস্থ হয়ে ওঠেন তাঁর মা। সংগঠনটির সদস্যদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন তিনি।

মোস্তাফিজুর রহমান একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। চাকরির পাশাপাশি তিনি স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করেন। তিনি বলেন, করোনাকালে যে বিষয়টি তাঁকে সবচেয়ে পীড়া দিয়েছে তা হলো, করোনায় মৃত ব্যক্তির দাফনে স্বজনদের অনীহা। তাঁরা এ সময় এগিয়ে এসেছেন। একে একে ১৫ জন করোনা রোগীর লাশ দাফন করেছেন শুধু ছয়ানী ইউনিয়নেই।

করোনায় মারা যাওয়া ছয়ানী গ্রামের বাসিন্দা আমান উল্যাহর ছেলে ইব্রাহিম খলিল প্রথম আলোকে বলেন, গত বছর করোনা ছড়িয়ে পড়ার কিছুদিনের মধ্যেই তাঁর বাবা করোনায় আক্রান্ত হন। সপ্তাহখানেক অসুস্থ থাকার পর তিনি মারা যান। মৃত্যুর পর যখন আশপাশের কেউই লাশ দাফনে এগিয়ে আসছিলেন না, তখন তাঁদের পাশে এসে দাঁড়ান শিখা সংসদের স্বেচ্ছাসেবকেরা। তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না।

সংগঠনের সভাপতি শাহদাত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, করোনাকালে তাঁদের সংগঠনের সেবার পরিধি ছাড়িয়েছে আশপাশের বিভিন্ন ইউনিয়ন, নোয়াখালী সদর ও লক্ষ্মীপুর জেলায়। করোনাকালে তাঁরা ৩৪২ জনকে বিনা মূল্যে অক্সিজেন সেবা দিয়েছেন। দিন-রাত যখনই কল পেয়েছেন, মোটরসাইকেলে করে অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে হাজির হয়েছেন।

উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শাহনাজ বেগম প্রথম আলোকে বলেন, প্রত্যন্ত গ্রামের একটি সামাজিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন করোনা মহামারিতে সেবা দেওয়ার যে নজির স্থাপন করেছে, তা অত্যন্ত প্রশংসনীয়।