নারী উদ্যোক্তা
বেগম রোকেয়ার পায়রাবন্দের সংগ্রামী বিউটি আক্তার
উদ্যোক্তা হিসেবে সফলতা পেয়েছেন বিউটি আক্তার। হয়ে উঠেছেন হস্তশিল্পের দোকানের মালিক।
বাল্যবিবাহের পর দিন যতই গড়ায়, যৌতুকের চাপ ততই বাড়তে থাকে। সেই সঙ্গে চলে মানসিক নির্যাতনও। এরই মধ্যে কোলজুড়ে আসে কন্যাসন্তান। তারপরও সংসার টেকেনি। দুই বছরের সন্তানকে কোলে নিয়ে ফিরে আসেন বাবার ভিটেয়।
ভাইয়ের সংসারে ‘বোঝা’ হয়ে থাকার চেয়ে তিনি নিজেই কিছু করার চেষ্টা করেন। জীবিকার তাগিদে এখানে–ওখানে চাকরি করেন। শেষ পর্যন্ত উদ্যোক্তা হিসেবে সফলতার দেখা পেয়েছেন বিউটি আক্তার। হয়ে উঠেছেন হস্তশিল্পের দোকানের মালিক।
২৯ বছর বয়সী বিউটির বাড়ি রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার পায়রাবন্দ ইউনিয়নের খোর্দ মুরাদপুরে। ছয় ভাইবোনের মধ্যে বিউটি সবার ছোট। বাবা মরহুম আজগর আলী। মা আছিয়া খাতুন।
পায়রাবন্দের খোর্দ মুরাদপুর গ্রামেই ‘বেগম রোকেয়া হ্যান্ডিক্র্যাফটস’ দোকান। সেখানে এখন লক্ষাধিক টাকার মাল রয়েছে। এসব পণ্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ওয়ালম্যাট, ডাইনিং ম্যাট, পাপশ, শিশুদের খেলনা ও শতরঞ্জি। বিক্রিও ভালো। পর্যটকেরা বেগম রোকেয়ার জন্মস্থান পায়রাবন্দে ঘুরতে এসে এসব পণ্য কিনে থাকেন।
বিউটি জানান, ছোটবেলা থেকেই অভাব-অনটনের মধ্যে বড় হয়েছেন। এক বেলা খাবার জুটলে অন্য বেলায় উপোস থাকতে হতো। তার ওপর বাবা নেই। ভাইয়ের সংসারে বড় হয়েছেন। গ্রামের স্কুল থেকে ১৩ বছর বয়সে ২০০৪ সালে রংপুর নগরের সর্দারপাড়া এলাকায় এক যুবকের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়।
বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ির লোকজন গায়ের রং ফর্সা না হওয়ায় ছিলেন অসন্তুষ্ট। নানা ধরনের বিরূপ মন্তব্যও করতেন। প্রতিনিয়ত যৌতুকের জন্য চাপ দিত। বাড়ি থেকে টাকা নিয়ে আসতে বাধ্য করার চেষ্টা চলত। কিন্তু এই টাকা দেওয়ার সাধ্য নেই তাঁদের পরিবারের। ফলে সেই সংসার আর বেশি দিন টেকেনি। দুই বছরের কোলের শিশুকে নিয়ে ফিরে আসেন সেই চিরচেনা গ্রামের বাড়িতে।
বিউটির চলে আসা তাঁর ভাইবোনেরা খুব একটা ভালোভাবে নিতে পারেননি। তবে বিউটি ভাবলেন, কারও বোঝা হবেন না। নিজেকে বাঁচতেই হবে। সন্তানকেও লালনপালন করে বড় করে তুলতে হবে। এত কষ্টের মধ্যেও উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এইচএসসি পাসও করেন।
বিউটি আরও জানান, সন্তানের মুখের দিকে চেয়ে কাজের সন্ধানে ছুটে গেলেন পায়রাবন্দে রফিকুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তির কাছে। গ্রামে তাঁর একটি পাঠাগার আছে। ২০০৮ সালে সেই পাঠাগারে পাঠকদের নিয়ে কাজ শুরু করেন তিনি। এর বিনিময়ে তিনি মাত্র ৬০০ টাকা সম্মানী পেতে শুরু করেন। তা দিয়ে তাঁর বাচ্চার খাওয়াটা কোনো রকমে চলত। ২০১৪ সাল পর্যন্ত সেই পাঠাগারেই কাজ করেন তিনি।
২০১৫ সালে পায়রাবন্দের খোর্দ মুরাদপুর গ্রামের বেগম রোকেয়া হ্যান্ডিক্র্যাফটস দোকানে বিক্রয়কর্মী হিসেবে চাকরি জোটে বিউটির। তিনি বলেন, মাস শেষে যে বেতন পেতেন, সেই টাকা দিয়ে মেয়ের পড়ালেখা চলতে থাকে। মেয়েটি এখন নবম শ্রেণিতে পড়ছে।
ব্যবসা ভালো না হওয়ায় ২০১৯ সালে মালিক দোকানটি ছেড়ে দেন। সামান্য টাকার বিনিময়ে দোকানটি ভাড়া নেন বিউটি। একটি বেসরকারি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে সেখানে নিজেই হস্তশিল্প পণ্যের দোকান দিয়ে বসেন। ব্যবসা ভালো হওয়ায় এখন সুখের মুখ দেখছেন বিউটি। তাঁর একমাত্র কন্যা বেগম রোকেয়া মেমোরিয়াল উচ্চবালিকা বিদ্যালয়ে পড়ালেখা করছে। পাশাপাশি তিনি বৃদ্ধ মায়ের পাশেও দাঁড়িয়েছেন।
বিউটির এমন সংগ্রামী জীবন দেখে পায়রাবন্দে আরও অনেক নারী কর্মমুখী হয়ে উঠেছেন। তাঁরাও ব্যবসা করছেন। কেউ শহর থেকে কাপড় কিনে এনে জামা বানিয়ে গ্রামের বাজারে বিক্রি করছেন। কেউ কাপড়ের দোকান দিয়েছেন। কেউবা হস্তশিল্পের পণ্য বানিয়ে গ্রাম ও শহরে বিক্রি করছেন।
রূপালী বেগম নামের এক নারী বলেন, ‘বিউটি যদি পারেন। আমরা কেন পারব না। জামাকাপড় বানিয়ে পায়রাবন্দসহ এর আশপাশের এলাকায় বিক্রি শুরু করেছি।’
স্থানীয় বাসিন্দা বেগম রোকেয়া স্মৃতি পাঠাগারের উদ্যোক্তা রফিকুল ইসলাম বলেন, ভূমিহীন পরিবারের সন্তান বিউটি। বাল্যবিবাহের পর যৌতুকের নির্যাতনে স্বামীর সংসার না হলেও বিউটি ঘুরে দাঁড়িয়ে স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছেন। পায়রাবন্দে এর চেয়েবড় আর কী উদাহরণ হতে পারে।