ব্ল্যাক বেঙ্গল বদলে দিল অঞ্জনার দিন
অঞ্জনা বেগমের সংসারজুড়ে ছিল শুধুই গঞ্জনা। অভাব-অনটনের সংসারে শান্তি ছিল অধরা। অভাবের কারণে পাঁচ সদস্যের পরিবারটিকে দিনের পর দিন না খেয়ে থাকতে হয়েছে। ঈদ-পার্বণে জোটেনি নতুন পোশাক। ছাউনির অভাবে ঘরে থেকেও বৃষ্টি-রোদে ভিজে-পুড়ে কেটেছে সময়।
এখন বদলে গেছে সেদিন। কারণে-অকারণে আর স্বামীর গঞ্জনা সহ্য করতে হয় না অঞ্জনাকে। বাড়িতে এখন খড়ের পরিবর্তে টিনের ছাউনি দেওয়া তিনটি ঘর। কেটে গেছে ভাত-কাপড়ের অনিশ্চয়তা। তাঁর তিন সন্তানই বিদ্যালয়ে যায়। অঞ্জনা বলেন, ‘কোনো নয়ছয় করে নয়, টানা ছয় বছর ধরে ছাগল পালনে ভাগ্য ফিরেছে।’
চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলার হাউলী ইউনিয়নের কাদিপুর গ্রামের পুলপাড়ার বাসিন্দা হাফিজুল ইসলামের স্ত্রী অঞ্জনা বেগম (৩০)। পৃথিবী বিখ্যাত ‘ব্ল্যাক বেঙ্গল’ জাতের ছাগল পালন করেন তিনি। তাঁর দেখাদেখি গোটা গ্রামজুড়ে বাড়িতে ছোট ছোট খামার তৈরি করে পালন করা হচ্ছে এই জাতের ছাগল। অঞ্জনার পথ ধরে অনেক নারীই এখন স্বাবলম্বী।
গত সোমবার দামুড়হুদা উপজেলার ডুগডুগি পশুর হাট ঘুরে চমকে যাওয়ার মতো একটি তথ্য পাওয়া গেল। বিক্রির জন্য ওই দিন হাটে আনা বেশির ভাগ ছাগলই ছিল কাদিপুর গ্রামের। হাটে দাঁড়িয়ে কথা হয় ডুগডুগি গ্রামের বাসিন্দা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সাবেক সদস্য ইউসুফ আলীর সঙ্গে। তিনিই জানান অঞ্জনার কথা।
তিন দিন পর বৃহস্পতিবার সকালে কাদিপুর গ্রামে ঢুকেই চোখে পড়ে মাঠে মাঠে অসংখ্য ছাগল। নারী-পুরুষ ও শিশুরা ছাগল চরাচ্ছে। গ্রামের একটি খড়ের মাঠে এক নারী দুই শিশুকে সঙ্গে নিয়ে চরাচ্ছিলেন কিছু ছাগল। পাশেই বেগুনের খেত পরিচর্যাকারী আব্বাস আলীর কাছে অঞ্জনা বেগমের সন্ধান চাইতেই তিনি জানান, ছাগল চরানো ওই নারীই অঞ্জনা বেগম।
সদ্য চাষ দেওয়া জমির ঢেলা-মাটি মাড়িয়ে খড়ের মাঠে গিয়ে কথা হয় অঞ্জনার সঙ্গে। কোনো রকম জড়তা ছাড়াই ওই নারী তাঁর জীবন-সংগ্রামের গল্প শোনান। জানান, মাত্র ১২ বছর বয়সে পাশের জয়রামপুর গ্রামে বিয়ে হয়। স্বামী হাফিজুল ইসলাম ছিলেন বেকার। কারণে-অকারণে তাঁকে টাকা নিতে বাবার বাড়িতে পাঠাতেন। টাকা না নিয়ে গেলে নানা রকম গঞ্জনা ও নির্যাতন করা হতো। পরপর তিন মেয়ে হওয়ায় নির্যাতনের মাত্রা আরও বেড়ে যায়। বাবার বাড়ির লোকজন অতিষ্ঠ হয়ে সাত বছর আগে জয়রামপুর থেকে তাঁকে কাদিপুরে নিয়ে আসেন। এরপর কাদিপুর গ্রামে পারিবারিক জমিতে ভাইয়েরা তাঁর জন্য খড়ের ঘর তৈরি করে দেন। সেখানে তিন মেয়েকে নিয়ে বসবাস শুরু করার একপর্যায়ে স্বামীও আসেন।
যেভাবে ছাগল পালন শুরু: অঞ্জনা জানান, ছয় বছর আগে ডুগডুগি পশুর হাট থেকে দুই হাজার ২০০ টাকা দিয়ে তিনি একটি ব্ল্যাক বেঙ্গল জাতের ছাগী কেনেন। চার মাসের মাথায় ছাগীটি তিনটি বাচ্চা দেয়। বছর ঘুরতেই আরও ছয়টি বাচ্চা আসে ঘরে। এভাবে গত ছয় বছরে বেড়ে চলেছে ছাগলের সংখ্যা। ছাগল পালনে সাফল্য আসার পর স্বামীও স্বভাব পাল্টে ফেলেন। ভালো আচরণ করতে থাকেন। গত বছর দুই লাখ টাকার ওপরে ছাগল বিক্রি করেছেন। সংসারের খরচ মিটিয়ে এক লাখ টাকা সঞ্চয় করেছেন। বর্তমানে তাঁর ছাগল আছে ১৬টি।
অঞ্জনা বলেন, ‘সুংসারের অবাব দূর হইয়েচে। এবেড্ডা মেইয়ে তিনডেকে ভালোমতো লিকাপড়া শিকিয়ে মানুষির মতো মানুষ করতি চাই। আমি নিজি অল্প বয়সে বিয়ে কইরে ভুল করিচি, মেয়েগের সে ভুল করতি দেব না।’
অঞ্জনার স্বামী হাফিজুল ইসলাম বলেন, ‘আমার বউ ছাগল পাইলে সুংসারের কষ্ট দূর করেচে। আমরা অ্যাকন অনেক সুকী।’