মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে ২৪ বছর আগের মাগুরছড়া গ্যাসকূপ বিস্ফোরণে খনিজ তেল-সম্পদের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছিল। একইভাবে মাগুরছড়া কূপসংলগ্ন লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানেরও পরিবেশ-প্রতিবেশ এবং প্রাণবৈচিত্র্যের অনেক ক্ষতি হয় ওই ঘটনায়। জাতীয় উদ্যান থেকে অনেক পাখি, অনেক গুল্মজাতীয় উদ্ভিদ হারিয়ে গেছে। অনেক পাখি ও উদ্ভিদের সংখ্যা কমে গেছে। বনাঞ্চল ও পরিবেশের ক্ষতিপূরণ আদায়ের কোনো উদ্যোগ নেই।
প্রাণ-প্রকৃতি গবেষক পাভেল পার্থ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি বলব মাগুরছড়া গ্যাসকূপ দুর্ঘটনা বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় রকমের পরিবেশ গণহত্যা। এই অগ্নিকাণ্ডের ফলে লাউয়াছড়াতে বেশ কিছু জিনিস দেখা যাচ্ছে না। এর মধ্যে আছে লতাগুল্মজাতীয় উদ্ভিদ। পাখি, সরীসৃপ শ্রেণির প্রাণী। এদের হয় অনেকটাই দেখা যাচ্ছে না। অনেকটাকে একদম কম দেখা যাচ্ছে। এ ছাড়া অগ্নিকাণ্ডে শুধু গাছাপালারই ক্ষতি করেনি। আদিবাসী খাসিয়া ও ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর ভাষার ওপরও এর প্রভাব ফেলেছে। খাসি ও ত্রিপুরা ভাষার অনেক গাছলতা বিলুপ্ত হওয়ায় নতুন প্রজন্ম সেগুলো সম্পর্কে জানে না। তাদের ভাষা থেকেও এসব গাছের নাম হারিয়ে যাচ্ছে।’
আমি বলব মাগুরছড়া গ্যাসকূপ দুর্ঘটনা বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় রকমের পরিবেশ গণহত্যা।পাভেল পার্থ, প্রাণ-প্রকৃতি গবেষক
১৯৯৭ সালের ১৪ জুন মধ্যরাতে হঠাৎ করে মাগুরছড়া গ্যাসকূপ খননের সময় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। কয়েক শ ফুট উচ্চতায় লাফিয়ে ওঠে আগুনের শিখা। আগুনের প্রচণ্ড তাপে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান, ঢাকা-সিলেট রেলপথ, শ্রীমঙ্গল-ভানুগাছ সড়ক, ফুলবাড়ী চা-বাগান, মাগুরছড়া পানপুঞ্জি, বিদ্যুৎ-লাইনসহ গ্যাসকূপসংলগ্ন এলাকা পুড়ে লন্ডভন্ড হয়ে যায়। সেই থেকে প্রতিবছর ১৪ জুনকে মাগুরছড়া দিবস হিসেবে পালন করে আসছে বিভিন্ন পরিবেশবাদী ও রাজনৈতিক সংগঠন।
গ্যাসকূপ বিস্ফোরণে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের মূল্যবান সেগুন প্রকৃতির গাছ, বাঁশ, অন্যান্য প্রজাতির বৃক্ষ, বৃক্ষলতায় আচ্ছাদিত ও জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ বনাঞ্চলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। এখানে বন্য পরিবেশে পোকামাকড়, কীটপতঙ্গ, সাপ, গিরগিটি, তক্ষক, মায়ামৃগ, বন্য শূকর, উল্লুক ও অসংখ্য প্রজাতির ছোট–বড় দুর্লভ প্রজাতির পাখির বাস রয়েছে। আগুনের তাপে বনাঞ্চলের ১০০ মিটার মারাত্মকভাবে, ৫০০ মিটার এলাকা ভূমিকম্প, গহ্বর সৃষ্টি, ভূমিধস ও অগ্নিদগ্ধের কারণে আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এলাকার বৃক্ষ, জীবজন্তু, মাছ, পাখি, কীটপতঙ্গ আগুনের তাপে পুড়ে মারা যায়। লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে মারাত্মক, আংশিক ও হালকাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার পরিমাণ ধরা হয়েছিল ৮৭ দশমিক ৫০ একর।
অগ্নিকাণ্ডের আগে লাউয়াছড়া বন ও বনের ভেতরে রেলপথের পাশে ‘নিটাম’ নামে একধরনের নগ্নবীজী উদ্ভিদ প্রচুর দেখা যেত। এখন তার দেখাই নেই।
গবেষকেরা মাগুরছড়া গ্যাসকূপ অগ্নিকাণ্ডের আগের ও পরের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে রেখেছেন। এর ভিত্তিতে তাঁরা বলছেন, অগ্নিকাণ্ডের আগে লাউয়াছড়া বন ও বনের ভেতরে রেলপথের পাশে ‘নিটাম’ নামে একধরনের নগ্নবীজী উদ্ভিদ প্রচুর দেখা যেত। এখন তার দেখাই নেই। এ ছাড়া প্রচুর ফার্ন, ছত্রাক ও শৈবাল ছিল। এগুলো স্যাঁতসেঁতে পরিবেশে থাকে। সেগুলোও এখন অনেক কম দেখা যায়। ‘লুমিনা ফানজাই’ নামে এক জাতের ছত্রাক থেকে অন্ধকারে আলো বের হতো। খুবই দুর্লভ এই ছত্রাক এখন আর দেখা যায় না। সাদা ফুলের একটি গাছ ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের ভাষায় ‘কুটুই রুগ্নি ক্লুম’ নামে পরিচিত। ত্রিপুরা সমাজের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ গাছটি। তারা মনে করে, গাছটি মৃত আত্মাকে স্বর্গের রাস্তা দেখিয়ে থাকে। এই গাছটিও এখন আর দেখা যায় না। ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের নতুন প্রজন্ম এই গাছটির নাম এখন জানেই না। লাউয়াছড়ায় অগ্নিকাণ্ডের আগে ও পরে প্রাণীদের মধ্যেও ভিন্নতা দেখা যাচ্ছে। অনেক পাখি এখন আর দেখা যায় না। পাখির আবাসস্থল ওলটপালট হয়ে গেছে। অনেক পাখি এখান থেকে সরে গেছে। লাউয়াছড়ার চেয়ে পাশের কালাছড়া বনে এখন অনেক বেশি পাখি দেখা যায়।
বন বিভাগ ও এলাকাবাসী সূত্রে জানা গেছে, ১৯৯৭ সালে গ্যাস অনুসন্ধানকারী মার্কিন কোম্পানি অক্সিডেন্টাল মাগুরছড়া গ্যাসকূপ খনন শুরু করে। ওই বছরের ১৪ জুন গ্যাসকূপে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। প্রায় ৮৫০ ফুট গভীরতায় পৌঁছার পর হঠাৎ করে বিস্ফোরণের ফলে কূপে আগুন লাগে। প্রায় ৫০০ ফুট উচ্চতায় লাফিয়ে ওঠে আগুনের শিখা। আগুনের প্রচণ্ড তাপে ঢাকা-সিলেট রেলপথ এঁকেবেঁকে যায়। শ্রীমঙ্গল-ভানুগাছ সড়কের মাগুরছড়া অংশ, মাগুরছড়া আদিবাসী খাসিয়া পানপুঞ্জি, ফুলবাড়ী চা-বাগান, বিদ্যুৎ–লাইন ও লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের ব্যাপক এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
মাগুরছড়া গ্যাসকূপ বিস্ফোরণের পর দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানের জন্য বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় একটি তদন্ত কমিটি করে। কমিটি অক্সিডেন্টাল কোম্পানির অবহেলাকে দায়ী করে প্রতিবেদন দিয়েছিল। সে মোতাবেক, দুর্ঘটনায় বাণিজ্যিকভাবে উত্তোলনযোগ্য ২৪৫ দশমিক ৮৬ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পুড়ে যায়। প্রতিবেদনের ভিত্তিতে অক্সিডেন্টালের কাছে ১৪ হাজার কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দাবি করা হয়।
অন্যদিকে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, পশুপাখি, পরিবেশ, প্রাকৃতিক শোষণ ব্যবস্থা, প্রাকৃতিক উৎপাদন, পশুপাখির বসতি, ভূপৃষ্ঠের প্রাকৃতিক পানিপ্রবাহ, ভূগর্ভস্থ পানিস্তরের অধোগমন, প্রাণিবৈচিত্র্য, ভূমির অণুজীব এবং মৃত্তিকার ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। তা পুনর্বাসন ও স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে হলে ৬০০ কোটি টাকা প্রয়োজন। অক্সিডেন্টালের কাছে এই পরিমাণ টাকা ক্ষতিপূরণ দাবি করা হয়েছিল। কিন্তু বনাঞ্চল ও পরিবেশের জন্য এ পর্যন্ত কোনো ক্ষতিপূরণ মেলেনি।
বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা রেজাউল করিম চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি বেশি দিন হয়নি এখানে এসেছি। আমি আসার পর এ বিষয়ে কোনো আলোচনা হয়নি।’