বরগুনা
ভাঙনের ঝুঁকিতে ৩০ কিলোমিটার বাঁধ
ঝড় ও জলোচ্ছ্বাস হলে উপকূলীয় এলাকার মানুষের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বেশি হয়। জেলায় ঝড় ও জোয়ারে এক কিলোমিটার বাঁধ বিলীন হয়ে গেছে।
দেশে কোনো ঘূর্ণিঝড় হলেই বরগুনা জেলার বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধের ঝুঁকিপূর্ণ প্রায় ৩০ কিলোমিটার নদীতে বিলীন হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়। এ কারণে বাঁধের ওই অংশের নদীপারের মানুষ আতঙ্কে থাকে। এসব বাঁধ বিলীন হলে কয়েক লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়বে বলে পাউবো ও জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা ধারণা করছেন।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) বরগুনা কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, জেলার ২২টি পোল্ডারে ৮০৫ কিলোমিটার বাঁধের মধ্যে বর্তমানে প্রায় ৩০ কিলোমিটার বাঁধ ঝুঁকিতে রয়েছে। এর মধ্যে বরগুনা সদর উপজেলায় ৬.৬৮৬ কিলোমিটার, আমতলীতে ৪.৪৩০ কিলোমিটার, তালতলীতে ৪.৯২ কিলোমিটার, পাথরঘাটায় ৫.৬৬৫ কিলোমিটার, বামনা উপজেলায় ৭.২৪৭ কিলোমিটার ও বেতাগীতে ৮৫০ মিটার রয়েছে।
পাউবো বরগুনা কার্যালয় সূত্র জানায়, বরগুনার ২২টি পোল্ডারের অধীন ৮০৫ কিলোমিটার বাঁধের মধ্যে ঘূর্ণিঝড় সিডর, ইয়াস, বিভিন্ন সময় প্রবল বৃষ্টি ও উচ্চ জোয়ারের প্রভাবে এক কিলোমিটার বিলীন হয়ে গেছে।
‘জেলায় বাঁধের এমন কোনো অংশ নেই, যেখান দিয়ে নদীর পানি লোকালয়ে প্রবেশ করতে পারে। তবে প্রায় ৩০ কিলোমিটার বাঁধ ঝুঁকিতে আছে। এসব স্থানের তালিকা তৈরি করে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি।’মো. নুরুল ইসলাম, বরগুনা কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী
উপকূলের কয়েকজন বাসিন্দা বলেন, স্থায়ী ও টেকসই বাঁধের অভাবে ঝড় ও জলোচ্ছ্বাস হলে উপকূলীয় এলাকার মানুষের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বেশি হয়। বিভিন্ন সময় ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে বাঁধগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বাঁধ সংস্কারে উদ্যোগ না নেওয়ায় তারা ঝুঁকিতে রয়েছে।
ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের সময় পাথরঘাটা উপজেলার বলেশ্বর তীরবর্তী পদ্মা এলাকার বেড়িবাঁধ উপচে লোকালয়ে পানি ঢুকে পড়ে। সে সময় ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছিল। এখনো উঁচু জোয়ারে এ স্থান দিয়ে লোকালয় পানি ঢুকছে।
পাথরঘাটার পদ্মা গ্রামের বাসিন্দা ফিরোজা বেগম বলেন, ‘আমাদের বাড়ির সামনের বেড়িবাঁধটি নদীতে ধসে গেছে। বড় জোবা (জোয়ার পানি বেশি হলে) হলে পানি এই বাঁধ উপচে গড়িয়ে পড়ে আমাদের উঠানে পানি ঢুকে চারপাশ তলিয়ে যায়। আমরা সব সময় ভয়ে থাকি কোন সময় জোয়ারের পানি আমাদের ভাসিয়ে নিয়ে যায়। একটি বাঁধের জন্য আমরা আর কত দিন অপেক্ষা করব?’
বাঁধ সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করে ফিরোজা বেগম আরও বলেন, ‘পদ্মা গ্রামের বেড়িবাঁধ সংস্কার না করায় মানুষের দুঃখ-কষ্টের শেষ নেই। প্রতিদিন দুইবার জোয়ার শেষে পানিতে ভাসতে হয়। যত দ্রুত সম্ভব এলাকার ভাঙা বাঁধগুলো সংস্কার করা প্রয়োজন। এই এলাকার জীবন-জীবিকা স্বাভাবিক রাখতে হলে ভাঙনকবলিত এলাকায় ঘরবাড়ি, ফসলি জমি সব নদীতে গ্যাছে। আমরা এহন নিঃস্ব। মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকু নাই। ভাঙন রোধে স্থায়ী ব্যবস্থা না নিলে পুরো এলাকাই নদীতে বিলীন হয়ে যাবে।’
পাথরঘাটা উপজেলার বলেশ্বর নদের তীরবর্তী পদ্মা গ্রামের বাসিন্দা মিলন তালুকদার বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের উচ্চ জোয়ারের প্রভাবে বাঁধ নদীতে বিলীন হয়ে যায়। বর্তমানে বাঁধে মাটির ভর্তি বস্তা ফেলে কোনোমতে লোকালয়ে পানি ঢোকা বন্ধ করা হয়েছে। ঘূর্ণিঝড় সিডরের সময় নদীতে বিলীন হওয়ার পর এখন পর্যন্ত কোনো স্থায়ী বা টেকসই বাঁধ নির্মাণ করা হয়নি।’
সরেজমিনে পাথরঘাটা উপজেলার বলেশ্বর তীরবর্তী পদ্মা গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের উচ্চ জোয়ারের প্রভাবে নদীতে বিলীন হয়ে যাওয়া ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধে মাটিভর্তি বস্তা ফেলে রাখা হয়েছে। স্বাভাবিক জোয়ারের পানি লোকালয় প্রবেশ থামানো গেলেও ঘূর্ণিঝড়ও উচ্চ জোয়ার প্রবাহিত হলে এ স্থান দিয়ে পানি ঢুকে বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হবে।
তালতলীর তেঁতুলবাড়িয়া এলাকার বাসিন্দা শাহাদাত মিয়া (৪০) বলেন, ‘সিডরের সময় এই এলাকার বাঁধ ভেঙে গেলেও এখন পর্যন্ত মজবুত বাঁধ নির্মাণ হয়নি এই এলাকায়। এখন আবার ঘূর্ণিঝড় হওয়ার কথা শুনছি।’
ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচির (সিপিপি) বরগুনা সদর উপজেলার দলনেতা জাকির হোসেন বলেন, ‘যখন কোনো ঘূর্ণিঝড়ের সতর্কসংকেত দেওয়া হয়, তখন সবার টনক নড়ে। উপকূলের নদ-নদীতে অস্বাভাবিক জোয়ারে ১৫-১৮ ফুটের অধিক পানি বৃদ্ধি পায়। জলবায়ুর প্রভাবে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পেলেও বাঁধের উচ্চতা কম থাকায় উচ্চ জোয়ারে বাঁধ তলিয়ে লোকালয় পানি প্রবেশ করে। উপকূলের বাসিন্দাদের ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষার জন্য বাঁধের উচ্চতা বাড়ানো দরকার।’
এ বিষয়ে পাউবো বরগুনা কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. নুরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘জেলায় বাঁধের এমন কোনো অংশ নেই, যেখান দিয়ে নদীর পানি লোকালয়ে প্রবেশ করতে পারে। তবে প্রায় ৩০ কিলোমিটার বাঁধ ঝুঁকিতে আছে। এসব স্থানের তালিকা তৈরি করে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি।’