ভিখারিনিও রক্ষা পেলেন না ‘তাদের’ হাত থেকে

হাসিলা বেগমের লাশ মাঠ থেকে উদ্ধার করছে পুলিশ। গত মঙ্গলবার বগুড়ার ধুনট উপজেলার কালেরপাড়া ইউনিয়নের ঘুগরাপাড়া গ্রামেপ্রথম আলো

সারা দিন গ্রামে গ্রামে ঘুরে ভিক্ষা করে জীবিকা চালাতেন হাসিলা বেগম (৪১)। দিন শেষে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে হাঁড়িতে চড়াতেন ভিক্ষা করে পাওয়া চাল। সঙ্গে ভিক্ষার সামান্য টাকায় কেনা ডাল, আলু বা দু-একটি সবজি। গত মঙ্গলবার ধানখেতের পাশে একটি পতিত জমি থেকে সেই হাসিলা বেগমেরই গলায় ওড়না দিয়ে ফাঁস লাগানো অবস্থায় লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। তখন জানা যায়, আগের দিন সোমবার সন্ধ্যায় ভিক্ষা শেষে বাড়ি ফিরে পাশের আনারপুর গ্রামে বোনের বাড়ি গিয়েছিলেন তিনি। ফেরার পথে তাঁকে শ্বাসরোধে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা।

ঘটনার সূত্র ধরে গতকাল শুক্রবার রাতে সন্দেহভাজন হিসেবে সিএনজিচালিত অটোরিকশার দুই চালককে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তাঁরা হলেন আনারপুর কচুগাড়ি গ্রামের সামছুল মণ্ডলের ছেলে বাদশা আলম (২৮) এবং হঠাৎপাড়া গ্রামের বাদু মণ্ডলের ছেলে ফজলুল হক (৩২)। এই আসামিরাই হাসিলা বেগমকে ধর্ষণচেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে শ্বাসরোধে হত্যার দায় স্বীকার করে আজ শনিবার আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।

হাসিলা বেগম
ছবি: সংগৃহীত

হাসিলা বেগম হত্যার ঘটনায় তাঁর বোন ধলি বেগম বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা আসামি করে গত মঙ্গলবার রাতে থানায় হত্যা মামলা করেছিলেন। ওই মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে সিএনজিচালিত অটোরিকশাচালক বাদশা আলম ও ফজলুল হককে আজ দুপুরের পর বগুড়া আমলি আদালতে তোলা হয়। এর আগে গতকাল রাতে তাঁদের নিজ বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করে ধুনট থানা-পুলিশ। আদালতের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট খালিদ হাসান আজ সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় তাঁদের জবানবন্দি গ্রহণ করে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।

হাসিলা বেগম ধুনটের কালেরপাড়া ইউনিয়নের ঘুগরাপাড়া গ্রামের শুকর আলী মণ্ডলের মেয়ে। গত সোমবার রাতে পাশের গ্রামে বোনের বাড়ি থেকে ফেরার সময় আসামিরা তাঁকে ধানখেতের পাশে নিয়ে ধর্ষণের চেষ্টা করেন। তাতে ব্যর্থ হয়ে পরে শ্বাসরোধে হত্যা করেন তাঁকে। পরদিন মঙ্গলবার সকাল ৯টার দিকে ধুনট থানা-পুলিশ বাড়ি থেকে ৫০০ মিটার দূরে গলায় ওড়না দিয়ে ফাঁস লাগানো অবস্থায় তাঁর লাশ উদ্ধার করে। এরপর ময়নাতদন্তের জন্য লাশ পাঠানো হয় বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। রাতে নিহতের বড় বোন ধলি বেগম হত্যা মামলা করেন।

আমি বাবাকে চোখে দেখি নাই। দুই মাস বয়সে বাবা মারা গেছেন। মা ভিক্ষা করেও আমার পেটের ভাত জোগাতে পারেন নাই। ছোটবেলা থেকে তাই আমি খালার কাছেই থাকি। খালার কোনো সন্তান ছিল না। মা বেঁচে ছিল, এখন থেকে সেই মায়ের মুখটা দেখার আর ভাগ্য হবে না।
হাসেম আলী, নিহত হাসিলা বেগমের ছেলে

পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, প্রায় ২৬ বছর আগে হাসিলা বেগমের বিয়ে হয় রামনগর গ্রামের আজাহার আলীর ওরফে মোলা বক্সের সঙ্গে। সেখানে একটি পুত্রসন্তান হয় তাঁদের। বিয়ের দুই বছরের মাথায় আজহার আলী মারা যান। এরপর থেকে তিনি ঘুগরাপাড়া গ্রামে বাবার বাড়িতে থাকেন। একমাত্র ছেলে হাসেম আলী (২৫) থাকেন আনারপুর গ্রামে তাঁর খালা ধলি বেগমের সঙ্গে। তাঁদের দেখতেই সোমবার সারা দিন ভিক্ষা করে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে গিয়েছিলেন আনারপুর। সেখান থেকে ফেরার পথে হত্যা করে বাড়ির পাশে ৫০০ মিটার দূরে একটি ধানখেতের পাশে তাঁর লাশ ফেলে যাওয়া হয়।

নিহতের ছেলে হাসেম আলী কান্নাজড়িত কণ্ঠে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি বাবাকে চোখে দেখি নাই। দুই মাস বয়সে বাবা মারা গেছেন। মা ভিক্ষা করেও আমার পেটের ভাত জোগাতে পারেন নাই। ছোটবেলা থেকে তাই আমি খালার কাছেই থাকি। খালার কোনো সন্তান ছিল না। মা বেঁচে ছিল, এখন থেকে সেই মায়ের মুখটা দেখার আর ভাগ্য হবে না।’

ধুনট থানার পরিদর্শক (তদন্ত) কামরুজ্জামান বলেন, গ্রেপ্তার দুই আসামি বাদশা আলম ও ফজলুল হক হাসিলা বেগমকে ধর্ষণচেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে হত্যার দায় স্বীকার আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। আদালতের নির্দেশে তাঁদের কারাগারে পাঠানো হয়েছে।