‘মাছ ধরাটা যেমন-তেমন, আনন্দটাই আসল’
ভোরের আকাশে সবে উঁকি দিয়েছে সূর্য। রক্তিম আভা ছড়িয়ে পড়েছে প্রকৃতিতে। কাঁধে ফিকা জাল, খালই নিয়ে নদের পাড়ে জড়ো হতে শুরু করেছেন লোকজন। কেউ কেউ পাড়ে, কেউ আবার কোমরপানিতে দাঁড়িয়ে জাল ফেলা শুরু করেছেন। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে মানুষের ভিড়। একসময় তা রূপ নেয় উৎসবে। কেউ একটা বড় মাছ ধরলেই করছেন চিৎকার-চেঁচামেচি।
এই চিত্র আজ সোমবার ভোরের ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার সুক নদের ওপরের বুড়ির বাঁধ (জলকপাট) এলাকার।
প্রতিবছর বাংলা পঞ্জিকার কার্তিক মাসের এই সময়ে খুলে দেওয়া হয় জলকপাট। বাঁধে আটকে থাকা পানিতে নেমে পড়েন এলাকার মানুষ। তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন আশপাশের শহর-গ্রামের লোকজন। এটা একসময় রূপ নেয় মাছ ধরার উৎসবে। এটা চলে তিন-চার দিন। মাছ ধরা এই উৎসব ঘিরে এলাকা পরিণত হয় মিলনমেলায়। কিন্তু এবার মাছ ধরতে গিয়ে আশানুরূপ মাছ না পেয়ে অনেকেই হতাশ।
এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শুষ্ক মৌসুমে কৃষিজমিতে সেচসুবিধার জন্য ১৯৭৫-১৯৭৬ সালে সুক নদের ওপর বুড়ির বাঁধ নামের একটি জলকপাট নির্মাণ শুরু হয়ে শেষ হয় ১৯৮২ সালে। জলকপাটে আটকে থাকা পানিতে প্রতিবছর মৎস্য বিভাগ বিভিন্ন জাতের মাছের পোনা ছাড়ে। এই পোনাগুলো যাতে কেউ ধরতে না পারে, তা দেখভাল করে সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদ। এরপর কার্তিক মাসের প্রথম বা দ্বিতীয় দিনে বাঁধের পানি ছেড়ে দিয়ে সেসব মাছ সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। জলকপাট নির্মাণের পর থেকেই উৎসবের এ রেওয়াজ চলে আসছে।
আজ ভোরে বুড়ির বাঁধ এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, নানা বয়সের মানুষের ভিড়। একজন অন্যজনের গা ঘেঁষে পানিতে জাল ফেলছেন। কখনো কখনো একজনের জাল অন্যের জালের ওপরে পড়ছে। দু–একটি পুঁটিজাতীয় ছোট মাছ পেলেও অধিকাংশ সময় জাল থাকছে মাছশূন্য। বাঁধের ওপর দাঁড়িয়ে তাঁদের উৎসাহ দিচ্ছেন তাঁদের বন্ধুবান্ধব ও স্বজনেরা।
পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার কুমারপাড়া থেকে আটজন মাছ ধরতে এসেছেন। দুপুরে বিশ্রাম নেওয়ার ফাঁকে কথা হয় মো. খোকনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘দুই-তিন বছর আগে মাছ ধরে প্রতিদিন চার-পাঁচ হাজার টাকা বিক্রি করতাম। কিন্তু আজ দুই কেজিও মাছ পাইনি।’
চিলারং এলাকার কৃষক অশোক রায় (৫০) বলেন, ‘প্রতিবছর আমরা বাঁধের পানিতে মাছ ধরতে আসি। প্রতিদিন গড়ে ১০ কেজি করে মাছ পেতাম। কিন্তু এবার একেবারেই মাছ নেই। পানিতে যেটুকু মাছ আছে, সেটা এলাকার মানুষ জাল দিয়ে ঘিরে রেখেছে। সেসব মাছ সেখান থেকে বের হতে পারছে না।’
বকসেরহাট এলাকার বাসিন্দা ইসমাইল হোসেন (৪৫) বলেন, ‘আমরা দলবল নিয়ে প্রতিবছর শখের বশে এখানে মাছ ধরতে আসি। গত বছর যেভাবে মাছ পেয়েছি, এ বছর সেভাবে মাছ পাচ্ছি না। সারা বছর এলাকার লোকজন কারেন্ট জাল, রিংজাল দিয়ে বাঁধের ছোট পোনা ও মা মাছ নিধন করে। এতেই মাছের সংকট দেখা দিয়েছে। আর লোকজন হতাশ হয়ে ফিরে যাচ্ছে।’
বাঁধের পানিতে মাছ ধরতে এসে কয়েকটি পুঁটি ও দুটি শোল মাছ ধরেছেন আখানগর এলাকার সমিরউদ্দিন (৩৯)। দুপুর পর্যন্ত মাছ তেমন না পেলেও হইহুল্লোড় করে দিনটি কাটছে, এতেই তিনি বেশ খুশি। মাছ ধরতে ধরতে একসময় তাঁদের চাপা-পড়া পেটের খিদেটা চাগিয়ে উঠে। খাবারের পোটলা থেকে ভাত, সবজি ও শাক বের করে খেতে বসে গেলেন তাঁরা। সে সময় পাশ থেকে এক ব্যক্তি খালইয়ের মাছ দেখিয়ে বলেন, ‘এই মাছলা খাবেন কবে?’ কথাটি শুনে সে সময় সমিরউদ্দিন বললেন, ‘যতলা মাছ পাইছু?’
বিভিন্ন এলাকার সাত বন্ধুর একটা দল নিয়ে মাছ ধরতে এসেছেন সামিউল হক (৩৪)। বাঁধের পানিতে পাঁচবার জাল ফেলে তিনি একটিও মাছ পাননি। ষষ্ঠবারে একটি পুঁটি মাছ পেয়ে তাঁদের কী যে আনন্দ। সে সময় সামিউলের কাছে অনুভূতি জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মাছ পাই আর না পাই, আমরা প্রতিদিনই এখানে জাল নিয়ে মাছ ধরতে নেমে পড়ব।’ পাশে দাঁড়িয়ে মাহবুব আলম (৩৩) নামের এক যুবক বলতে লাগলেন, ‘মাছ ধরাটা যেমন-তেমন, আনন্দটাই আসল।’
সদর উপজেলার আকচা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান সুব্রত কুমার বর্মণ বলেন, কার্তিক মাসের এ সময়ে বাঁধের পানি ছেড়ে দেওয়ার পর সেখানে স্থানীয় ও আশপাশের মানুষ দল বেঁধে মাছ ধরতে যান। মাছ ধরা তাঁদের অধিকাংশেরই পেশা নয়। এ মৌসুমে তাঁরা শখের বশে মাছ ধরেন। এতে তাঁরা আনন্দ পান।