মাদকের আখড়া এখন ‘পথের পাঠশালা’
রেলওয়ে স্টেশনের পরিত্যক্ত ভবনটি ছিল ময়লা-আবর্জনায় ঠাসা। সেখানে প্রতিদিন বসত মাদকসেবীদের আড্ডা। কয়েকজন তরুণের উদ্যোগে ভবনটি পরিষ্কার করা হয়। সেখানে এখন প্রতিদিন বিকেলে লেখাপড়া করানো হচ্ছে গরিব ও ছিন্নমূল শিশুদের। পড়াচ্ছেন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলা সদরের রেলওয়ে জংশন স্টেশন এলাকায় গড়ে তোলা শিক্ষাকেন্দ্রটির নাম দেওয়া হয়েছে পথের পাঠশালা। সেখানে পড়ছে বিভিন্ন বয়সী ৫৫ জন শিশু। এ ছাড়া কোরআন শিক্ষা নিচ্ছেন আরও ১৭ জন বয়স্ক মানুষ।
পথের পাঠশালার প্রধান সমন্বয়ক মো. আসাদুজ্জামান ঢাকার তিতুমীর কলেজে স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষে পড়েন। বাড়ি ঈশ্বরদী উপজেলা সদরের বিমানবন্দর এলাকায়।
আসাদুজ্জামান জানিয়েছেন, ঢাকায় পড়তে যাওয়ার আগে প্রতিশ্রুতি নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হন তিনি। সংগঠনটিতে ৩৫ জন সদস্য রয়েছেন। এর মধ্য থেকে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া ১৫ জন শিক্ষার্থী মিলে স্টেশনের ছিন্নমূল শিশুদের পড়ানোর উদ্যোগ নেন। সে অনুযায়ী ২০২০ সালে প্রতিশ্রুতি পথের পাঠশালা নাম দিয়ে স্টেশন প্ল্যাটফর্মেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম শুরু করেন। পরে করোনার কারণে স্কুল-কলেজ বন্ধ হলে তাঁদের কার্যক্রমও বন্ধ রাখতে হয়। তবে স্কুল-কলেজ খোলার সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা আবার শিশুদের পড়াতে শুরু করেন।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে যুক্ত তরুণদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শুরুর দিকে স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে বাচ্চাদের পড়াতে বেশ সমস্যা হতো। যাত্রীদের কারণে ওরা মনোযোগ ধরে রাখতে পারত না। তাই একটি নিরিবিলি জায়গা খোঁজা হচ্ছিল। ওই সময় প্ল্যাটফর্মের পাশে রেলওয়ের একটি পরিত্যক্ত ভবন তাঁদের নজরে আসে। রেল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মৌখিক আলোচনা করেই তাঁরা ভবনটি পেয়ে যান। তখন ভবনটি ময়লা-আবর্জনায় ভরা ছিল। ছিল মাদকের আখড়ায়ও। প্রথমে তাঁরা মাদকসেবীদের ভবনটিতে না বসার অনুরোধ করেন। পরে নিজেরাই ভবন পরিষ্কার করে সেখানে পথের পাঠশালার কার্যক্রম শুরু করেন।
আসাদুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, শুরুর দিকে প্রতিশ্রুতির ৩৫ জন সদস্য শিক্ষাকার্যক্রম চালানোর জন্য প্রতিদিন দুই টাকা করে দিতেন। এই টাকায় শিশুদের পড়ানোর পাশাপাশি কিছু খাবার দেওয়া হতো। বর্তমানে প্রত্যেক সদস্য মাসে ১০০ টাকা করে দিচ্ছেন। অনেকে স্বেচ্ছায় সহযোগিতা করেন। ফলে এখন শিশুদের পড়ালেখার পাশাপাশি খাবার এবং খাতা, কলম, বই কিনে দেওয়া হচ্ছে। ছিন্নমূল শিশুদের অনেককে কিনে দেওয়া হচ্ছে জামা-কাপড়ও।
ওই স্কুলে গিয়ে দেখা যায়, স্টেশনের পাশেই রেলওয়ের পরিত্যক্ত একতলা ভবন। ভবনের সামনে বসে পড়ছে একঝাঁক শিশু। হাতেখড়ি থেকে শুরু করে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানো হচ্ছে সেখানে। শিক্ষার্থীদের কেউ স্টেশনের ছিন্নমূল শিশু, কেউবা স্টেশনের আশপাশের দরিদ্র পরিবারের সন্তান। পাঁচজন শিক্ষক তাদের পড়াচ্ছেন, লেখাচ্ছেন।
শিশুদের পড়াচ্ছিলেন পাবনা সরকারি এডওয়ার্ড কলেজ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতকোত্তর পাস করা সুরাইয়া খাতুন। তিনি বলেন, ‘পড়াশোনা শেষ করে বেকার বসে ছিলাম। তাই শিশুদের পড়াতে শুরু করেছি। প্রতিদিন বিকেলটা ওদের সঙ্গে বেশ ভালো কাটছে।’
ওই পাঠশালায় শিশুকন্যাকে পড়াতে নিয়ে এসেছেন আয়শা খাতুন নামের এক নারী। তিনি বলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ। বাচ্চাক পিরাইভেট পড়াবের সাধ্যি নাই। তাই হেনে দিছি। আমার মিয়েডা লেহা শিখে গেছে।’
এ পাঠশালার বিষয়ে জানতে চাইলে স্থানীয় ব্যবসায়ী সাব্বির আহম্মেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘বহুদিন ধরেই কয়েকজন তরুণকে শিশুদের একত্র করে পড়াতে দেখছি। ওরা একটা ভালো কাজ করছে। নিজের হাতে পরিত্যক্ত ভবনটি পরিষ্কার করেছে। প্রতিদিন নিয়ম করে শিশুদের পড়াচ্ছে। দেখেই বুক ভরে যায়। বিষয়টি অন্য শিক্ষার্থীদের জন্য অনুসরণীয় বলে আমি মনে করি।’
জেলায় শিশু অধিকার নিয়ে কাজ করেন সমাজসেবা অধিদপ্তরের প্রবেশন কর্মকর্তা পল্লব ইবনে শায়েখ। পাঠশালাটির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘শিশু অধিকার রক্ষা ও শিশুদের সুরক্ষায় এটি স্থানীয় তরুণদের একটি চমৎকার উদ্যোগ। আমরা নিয়মিত ওদের খোঁজখবর রাখছি। কার্যক্রমটি চালিয়ে নিতে সহযোগিতার চেষ্টা করছি।’
ঈশ্বরদী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) পি এম ইমরুল কায়েস বলেন, ‘কার্যক্রমটি দেখতে বেশ কয়েকবার স্টেশনে গিয়েছি। উদ্যোগটি বেশ ভালো লেগেছে। আমরা বিভিন্নভাবে তাঁদের সহযোগিতা দিচ্ছি। পাঠশালাটি সঠিকভাবে চালিয়ে নিতে ভবিষ্যতেও সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে।’