নাটোর জেলার মানচিত্র

মামলাবাজি, সংশ্লিষ্টদের অদূরদর্শিতা ও অবহেলার কারণে নাটোর শহরের প্রধান সড়কটি চার লেনে উন্নীতকরণের প্রকল্পটি শহরবাসীর কাছে অধরাই রয়ে গেল। নির্ধারিত সময়ের তিন বছর পরও প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হয়নি। বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুত এই প্রকল্প নিয়ে শহরবাসীর মধ্যে হতাশা রয়েছে।

বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ২০১১ সালে নাটোরের একটি জনসভায় শহরের প্রধান সড়ক চার লেনে উন্নীতকরণের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। তাঁর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (এডিবি) অর্থায়নে ৫৮ কোটি ৩৩ লাখ টাকা ব্যয় নির্ধারণ করা হয়। একনেক ৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিলে ২০১৭ সালের ৬ অক্টোবর প্রকল্পের কাজ শুরু হয়।

সড়ক ও জনপথ বিভাগ (সওজ) নাটোর প্রকল্পটি বাস্তবায়নের সময় জানায়, নাটোর-রাজশাহী মহাসড়কের পূর্ব বাইপাস থেকে পশ্চিম বাইপাস পর্যন্ত ৫ দশমিক ৮৬ কিলোমিটার সড়ক ৪৮ ফুট প্রশস্ত করা হবে। ৪৮ ফুটের মধ্যে উভয় পাশে ৪ ফুট প্রশস্ত করে নালা (ড্রেন) হবে। নালার ওপরের অংশ পদচারী রাস্তা হিসেবে ব্যবহার করা হবে। সড়কের মধ্যে চার ফুট প্রশস্ত বিভাজক (ডিভাইডার) প্রাচীর থাকবে। যার মধ্যে শোভাবর্ধনকারী গাছপালা রোপণ করা হবে। পাশাপাশি শহরকে আলোকিত করতে সোডিয়াম বাতি লাগানো হবে। সড়ক বিভাজকের উভয় পাশে যান চলাচলের জন্য ১৮ ফুট করে পিচ কার্পেটিং সড়ক থাকবে। এর প্রতিটি অংশ নয় ফুট প্রশস্ত করে দুটি করে লেন করা হবে। ফলে উভয় পাশ মিলে চারটি লেন হবে।

প্রকল্পটি বাস্তবায়নের কাজ প্রথমে জোরেশোরে শুরু হলেও মাঝপথে এসে স্থবির হয়ে পড়ে। প্রশস্তকরণ করতে গিয়ে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন ভবনের অংশবিশেষ সড়কের মধ্যে পড়ে যায়। এসব স্থাপনা অপসারণে ভবনমালিকদের গড়িমসি ও সড়ক বিভাগের অবহেলায় কাজের গতি কমে আসে। সব মিলিয়ে ৫৪ দশমিক ৬৭ শতক জমি অধিগ্রহণের প্রয়োজন দেখা দেয়। এ জন্য ৭১ জন ভূমিমালিক ও ৩১ জন ভাড়াটিয়া ব্যবসায়ী ক্ষতিপূরণ দাবি করেন। ক্ষতিপূরণের জন্য ভূমির মূল্য বাবদ ২ কোটি ৮৫ লাখ ও ব্যবসায়িক ক্ষতি বাবদ ২০ লাখ ৭৬ হাজার টাকা প্রয়োজন পড়ে। প্রকল্প প্রস্তাবে এই টাকা বরাদ্দ না থাকায় নতুন করে মন্ত্রণালয়ে টাকার জন্য প্রস্তাব পাঠানো হয়। দীর্ঘদিনেও এ টাকার জোগান দিতে পারেনি সড়ক বিভাগ। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ভূমি অধিগ্রহণ কেস (এল/এ ৮/১৯-২০) নিষ্পত্তি না হওয়ায় ভূমিমালিকদের মধ্যে নয়জন জনৈক রুহুল আমীনকে আমমোক্তার নিয়োগ করে ভূমি অধিগ্রহণ মামলাটি বাতিল চেয়ে হাইকোর্টে রিট আবেদন (৮১৫১/২১) করেন। রিটে ভূমি মন্ত্রণালয়ের সচিব ও নাটোরের জেলা প্রশাসকসহ সাতজনকে প্রতিপক্ষ করা হয়। প্রাথমিক শুনানি শেষে ২০২১ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর হাইকোর্ট প্রতিপক্ষদের কারণ দর্শানোর আদেশ দেন। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে কারণ দর্শানো হলেও আজ অবধি রিটটি নিষ্পত্তি হয়নি।

এদিকে নাটোর জজ আদালতেও ভূমিমালিক ও ভাড়াটিয়াদের মধ্যে ক্ষতিপূরণের দাবিতে ১১টি মামলা করা হয়। এসব মামলায় জেলা প্রশাসনকে মোকাবিলা বিবাদী করা হয়। এ মামলাগুলো এখনো নিষ্পত্তি হয়নি। এসব মামলায় উন্নয়ন প্রকল্প বন্ধ রাখার নির্দেশনা না থাকলেও প্রশাসন ও সড়ক বিভাগ উন্নয়নকাজ চালিয়ে নিতে উদ্যোগ নেয়নি। ফলে মুখ থুবড়ে পড়েছে শহরের প্রধান সড়ক সম্প্রসারণের কাজ।

শহরের প্রধান সড়ক সম্প্রসারণ কাজের অন্যতম একটা অংশ সড়কের উভয় পাশে নালা নির্মাণ করা। শুরুতেই এ নালা নির্মাণের কাজ শুরু হয়। কিছু কিছু জায়গায় এখন পর্যন্ত নালা নির্মাণ শেষ না হলেও যেটুকু নির্মাণ করা হয়েছে, তা শহরবাসীর কোনো কাজে আসছে না।

নাটোর আইনজীবী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক শরিফুল হকের অভিযোগ, কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা নালা শহরবাসীর কোনো কাজেই আসছে না। সওজের যে প্রকৌশলী এ নালার নকশা প্রণয়ন করেন এবং যিনি অনুমোদন করেন তাঁর কাছে থেকে এর ক্ষতিপূরণ আদায় করা দরকার। তাঁরা বাস্তব অবস্থা উপলব্ধি না করে নালাটি নির্মাণ করেন।

সওজ নাটোরের নির্বাহী প্রকৌশলী আবদুর রহিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা প্রয়োজনীয় অর্থ ইতিমধ্যে সরবরাহ করেছি। জেলা প্রশাসন আমাদের ভূমি বুঝিয়ে দিলেই অসমাপ্ত কাজটুকু শেষ করব।’

সড়ক সম্প্রসারণ কাজের ঠিকাদার আমিরুল ইসলাম বলেন, ‘২০১৯ সালের জুনের মধ্যে সড়কটি সম্প্রসারণের কাজ শেষ করার কথা ছিল। কিন্তু সওজ ও প্রশাসন কিছু কিছু জায়গা আমাকে বুঝিয়ে না দেওয়ার কারণে প্রকল্পের কাজ শেষ করতে পারিনি। এতে আমি ব্যক্তিগতভাবেও অনেক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছি। আমার জামানতের টাকা আটকে আছে।’

জেলা ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা শওকত মেহেদী বলেন, ‘ভূমি অধিগ্রহণে আমাদের কোনো অবহেলা ছিল না। প্রত্যাশিত সংস্থা (সওজ) সময়মতো টাকা ছাড় না করার কারণে মাত্র সাত দিন দেরি হয়েছে। করোনাসহ নানা কারণে এ বিলম্ব। তবে সবচেয়ে বেশি সমস্যা হয়েছে মামলাবাজির কারণে। একটা মহল বাড়তি সুবিধা লাভের অপচেষ্টা করছে। তাঁরাই বিনা কারণে মামলা করে আমাদের স্বাভাবিক কার্যক্রমকে বিঘ্নিত করছে।’