‘মা’ ডেকে ধর্ষণ, আসামির খালাস, ছাত্রী ও তাঁর পরিবারের অসন্তোষ

ধর্ষণ
প্রতীকী ছবি

খুলনায় আলোচিত ‘মা’ ডেকে কলেজছাত্রীকে ধর্ষণের মামলার রায় ঘোষণা করা হয়েছে। রায়ে খালাস পেয়েছেন মামলার একমাত্র আসামি এনামুল হক ওরফে টিটো। গতকাল বুধবার দুপুরে ওই রায় ঘোষণা করা হয়। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৩–এ মামলাটি বিচারাধীন ছিল। রায় ঘোষণার পর ওই কলেজছাত্রী ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন।

মামলার বাদীপক্ষের আইনজীবী ছিলেন বি এম আবদুল আলীম। তিনি বলেন, বুধবার ছিল মামলার যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের (আর্গুমেন্ট) দিন। ওই সময় মামলার নথি তুলে দেখা যায়, ওই মামলার মূল তদন্ত কর্মকর্তা, চিকিৎসা কর্মকর্তাসহ গুরুত্বপূর্ণ তিনজনের সাক্ষ্য বাকি আছে। এ কারণে এদিন ওই তিনজনের সাক্ষ্য গ্রহণ করার জন্য আদালতে আবেদন করা হয়। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে করা ওই আবেদন বিচারক পরে শুনানি করবেন বলে জানান। কিন্তু বেলা আড়াইটার দিকে হঠাৎ শুনতে পান, মামলার রায় হয়ে গেছে। বিচারক আসামিকে খালাস দিয়েছেন।

বি এম আবদুল আলীম আরও বলেন, ‘কীভাবে এমন একটি চাঞ্চল্যকর মামলার রায় হঠাৎ ঘোষণা করা হলো, তা বুঝতে পারছি না। প্রায় সব সাক্ষীই বাদীপক্ষের অনুকূলে সাক্ষ্য দিয়েছেন। মামলার অভিযোগপত্রেও আসামিকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল। মামলাটি নিয়ে উচ্চ আদালতে আপিল করা হবে।’

মামলার রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ফরিদ আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আর্গুমেন্টের দিন ছিল। বাদীর আইনজীবী তিনজনের সাক্ষ্য গ্রহণ করার জন্য আবেদন করেছিলেন। মনে হয়, ওই আবেদন খারিজ করে বিচারক মামলার রায় ঘোষণা করেছেন।’

ইজিবাইকে চড়ে বাসায় ফেরার পথে এনামুল হকের সঙ্গে পরিচয় হয় মেয়েটির। প্রথম পরিচয়েই এনামুল তাঁকে ‘মা’ বলে সম্বোধন করেন। কিছুদিন আগে তাঁর মা মারা গেছেন, এ কারণে মেয়েটিকে তিনি (এনামুল) মা বলে ডাকার অনুমতি চান। এনামুল বয়স্ক মানুষ হওয়ায় বিষয়টি মেনে নেন ওই কলেজছাত্রী।

ধর্ষণের ওই মামলার পর্যবেক্ষক হিসেবে ছিল বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট)। ওই প্রতিষ্ঠানের খুলনার সমন্বয়কারী অশোক কুমার সাহা প্রথম আলোকে বলেন, যুক্তিতর্কের দিন হিসেবে যথারীতি পর্যবেক্ষণে গিয়েছিলেন তাঁরা। বাদীপক্ষের আইনজীবী আবেদন করার পর বিচারক সময় চাইলে তাঁরা আদালত থেকে চলে আসেন। পরে শুনতে পান, মামলাটির রায় ঘোষণা করা হয়েছে। এতে তাঁরা অবাক হয়েছেন। যেহেতু ব্লাস্ট শুরু থেকে ওই মামলার আইনগত সহায়তা দিচ্ছিল, তাই মামলাটির কপি তুলে উচ্চ আদালতে আপিল করবেন তাঁরা।

মামলার আসামিপক্ষের আইনজীবী ছিলেন মো. মনিরুজ্জামান। তিনি বলেন, বিচারক সাক্ষী ও মামলার কাগজপত্র পর্যালোচনা করে রায় ঘোষণা করেছেন। আগের দিন আসামিপক্ষের যুক্তিতর্ক হয়েছিল। ওই দিন বাদীপক্ষের যুক্তিতর্ক হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তাঁরা সেটা না করে সাক্ষীদের সাক্ষ্য নেওয়ার আবেদন করেন।

মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, ২০১৭ সালের ১৬ জানুয়ারি কলেজ থেকে ইজিবাইকে চড়ে বাসায় ফেরার পথে এনামুল হকের সঙ্গে পরিচয় হয় মেয়েটির। প্রথম পরিচয়েই এনামুল তাঁকে ‘মা’ বলে সম্বোধন করেন। কিছুদিন আগে তাঁর মা মারা গেছেন, এ কারণে মেয়েটিকে তিনি (এনামুল) মা বলে ডাকার অনুমতি চান। এনামুল বয়স্ক মানুষ হওয়ায় বিষয়টি মেনে নেন ওই কলেজছাত্রী। এরপর কলেজে যাওয়া-আসার পথে দেখা হলেই খাতির করতেন এনামুল। ১৯ জানুয়ারি তিনি মেয়েটিকে বাড়ির সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কথা বলে সোনাডাঙ্গা এলাকার একটি ছয়তলা বাসার ষষ্ঠ তলায় নিয়ে ছাদ থেকে ফেলে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে মেয়েটিকে ধর্ষণ করেন। লজ্জায় ও আতঙ্কে এ ঘটনা প্রথমে কাউকে বলেননি কলেজছাত্রী। ওই ঘটনায় আত্মহত্যাও করতে চেয়েছিলেন মেয়েটি। পরে মনকে শক্ত করে পরিবারকে ঘটনাটি জানিয়ে আইনি লড়াইয়ের প্রস্তুতি নেন। প্রায় দুই মাস পর ওই বছরের ১৫ মার্চ সোনাডাঙ্গা থানায় ধর্ষণের মামলা করেন মেয়েটি।

আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে ওই কলেজছাত্রীর মা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আসামিপক্ষ থেকে বেশ কয়েকবার টাকা দিয়ে মামলাটি মীমাংসা করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। আমরা চেয়েছিলাম আসামির সাজা হোক। এ কারণেই আইনিভাবে মামলাটি এত দিন লড়ে এসেছি। কিন্তু কীভাবে যে রায় ঘোষণা করা হলো, তা বুঝতে পারছি না। আদালতে থাকার পরও কিছুই জানতে পারিনি। আইনজীবীর ভাষ্য অনুযায়ী, মামলার নতুন তারিখ দেওয়ার কথা ছিল। পরে সেটি আনতে গিয়ে শুনি রায় ঘোষণা করা হয়ে গেছে, আসামিকে খালাস দেওয়া হয়েছে।’ তিনি বলেন, রায়ের পর তাঁর মেয়ে মুষড়ে পড়েছেন। তাঁরাও মানসিকভাবে ব্যাপারটি মেনে নিতে পারছেন না।