মুক্তিপণ না পেয়ে তরুণকে পিটিয়ে হত্যার তিন দিন পরও গ্রেপ্তার নেই

নরসিংদী সদর হাসপাতালের মর্গের সামনে নিহত মিঠুর স্বজনদের আহাজারি
ফাইল ছবি

নরসিংদীর মনোহরদীতে অপহরণের পর মুক্তিপণ না পেয়ে তরুণকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনার তিন দিন পেরোলেও, কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। এ ক্ষেত্রে পুলিশের ভাষ্য, অপরাধীরা নজরদারিতে আছেন, তাঁদের গ্রেপ্তার করে হত্যাকাণ্ডের রহস্য বের করা সময়ের অপেক্ষামাত্র।

বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টার দিকে উপজেলার একদুয়ারিয়া ইউনিয়নের হুগলিয়াপাড়া থেকে ওই তরুণের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। তাঁকে বুধবার রাতে অপহরণ করা হয়। নিহত মিঠু হোসেন (২৪) সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার রায়পুর এলাকার মৃত মোসলেম উদ্দিনের ছেলে। তিনি সিরাজগঞ্জের একটি ইসলামিয়া ডিগ্রি কলেজের বিএ প্রথম বর্ষে পড়াশোনার পাশাপাশি অনলাইনে শাড়ির ব্যবসা করতেন। বাবুরহাটের শাড়ি সম্পর্কে ধারণা নিতে প্রথমবারের মতো নরসিংদীতে এসেছিলেন। ফেসবুকে পরিচয় হওয়া দুই বন্ধুর ভরসায় নরসিংদীতে আসার পর অপহরণের শিকার হন তিনি।

মিঠু হোসেনের পরিবারের সদস্যরা জানান, বুধবার রাত ৮টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত অন্তত ৫০ বার মিঠুর মুঠোফোন থেকে কল করে এক লাখ টাকা মুক্তিপণ চান অপহরণকারীরা। পরে টাকা না পেয়ে পিটিয়ে হত্যার পর রাতেই মিঠুর লাশ একটি বাড়ির খড়ের গাদার নিচে ফেলে রাখা হয়। এমনকি হত্যাকাণ্ডের পরদিন বৃহস্পতিবার সকাল ১০টার দিকে স্থানীয় ব্যক্তিদের মাধ্যমে খবর পেয়ে যখন মিঠুর লাশ উদ্ধার করতে যাচ্ছিল পুলিশ, তখনো মুক্তিপণের টাকা চেয়েছিলেন অপহরণকারীরা।

এই ঘটনায় স্থানীয় অন্তত ১০ ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলেন এই প্রতিবেদক। তাঁরা জানান, যে বাড়ির খড়ের গাদার নিচ থেকে ওই তরুণের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে, তা মনোহরদীর একদুয়ারিয়া ইউনিয়নের হুগলিয়াপাড়ায় পড়লেও, তার ১৫০ ফুট দূরত্বেই শিবপুরের দুলালপুর ইউনিয়ন। নীরব-নির্জন ওই বাড়ির একপাশে দিগন্তবিস্তৃত খোলা মাঠ, ফসলের প্রান্তর। অন্য পাশে অন্তত ১৫০ গজ দূরে আরেকটি বাড়ি। তাঁদের ধারণা, এখানকার খোলা মাঠে অথবা অন্য কোথাও হত্যার পর ওই যুবককে এই খড়ের গাদার নিচে ফেলে যাওয়া হয়েছে।

নিহত ব্যক্তির পরিবারের সদস্যরা বলছেন, মিঠুর বাবা ছয় মাস আগে মারা গেছেন। তাঁর মা-ও দীর্ঘদিন ধরে ক্যানসারে আক্রান্ত। বাবার মৃত্যুর পর থেকে পড়াশোনার পাশাপাশি অনলাইনে শাড়ির ব্যবসা করে সংসার চালাতেন মিঠু। স্থানীয় বিভিন্ন হাট থেকে শাড়ি সংগ্রহ করে অনলাইনে বিক্রি করলেও, নরসিংদীর বাবুরহাটের কাপড় বিক্রির ইচ্ছা ছিল তাঁর। এই জন্য গত বুধবার সকালে সিরাজগঞ্জ থেকে নরসিংদীর উদ্দেশে রওনা হন। ঢাকায় পৌঁছার পর তিনি এক আত্মীয়ের বাড়িতে দুপুরের খাবার খান। পরে সন্ধ্যা ছয়টার দিকে নরসিংদী পৌঁছে পরিবারের সদস্যদের কাছে কল করে ঠিকঠাক পৌঁছানোর খবর জানান। তবে নরসিংদীতে ঠিক কাদের কাছে তিনি গিয়েছিলেন, তা কেউ জানতেন না।

মামলার বাদী ও মিঠুর বড় বোন মিনু আক্তার বলেন, বুধবার রাত ৮টার একটু আগে মিঠু তাঁর নিজের মুঠোফোন নম্বর থেকে কল করে তাঁদের জানান, তাঁকে আটকে রেখে মারধর করা হচ্ছে। তাঁর বিকাশ নম্বরে দ্রুত এক লাখ টাকা পাঠিয়ে দিতে বলেন মিঠু, নইলে ‘তারা আমাকে মেরে ফেলবে’ বলেন। তখন অপহরণকারীদের একজন ফোনটা ধরে বলেন, ‘আপনারা এই মুহূর্তে যদি এক লাখ টাকা পাঠান, তাহলে আপনার ভাইকে আমরা ছেড়ে দেব।’ মিনু আক্তার তাঁকে বলেন, ‘এখন তো রাত প্রায় ৮টা বাজে, এই সময় তো কারও কাছে টাকা চেয়ে পাব না, একটু সময় দিন, আমি টাকা পাঠানোর ব্যবস্থা করছি।’ রাত ১২টা পর্যন্ত অন্তত ৫০ বার মিঠুর ফোনেই অপহরণকারীদের সঙ্গে তাঁদের কথা হয়েছে। ফোনে কথা বলার পুরোটা সময় মারধর ও মিঠুর কান্নার শব্দ শুনেছেন। এমনকি রাত ১২টার দিকে যখন সিরাজগঞ্জ সদর থানায় সাধারণ ডায়েরি করা হচ্ছিল, তখনো মুক্তিপণের টাকা চেয়েছিলেন অপহরণকারীরা। অথচ পুলিশ তখনো কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।

এ বিষয়ে নরসিংদীর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) সাহেব আলী পাঠান প্রথম আলোকে বলেন, ‘হত্যাকাণ্ডটির পরপরই মনোহরদী থানা-পুলিশের পাশাপাশি র‍্যাব, ডিবি ও পিবিআই তদন্তে নেমেছে। এরই মধ্যে হত্যাকাণ্ড-সংশ্লিষ্ট কয়েকটি ক্লু পেয়েছি আমরা। কারা এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত, তাঁদের চিহ্নিত করার কাছাকাছি আমরা পৌঁছে গেছি। দ্রুতই তাঁদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনা হবে।’