মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পেতে জালিয়াতি, মহিলা আ. লীগ নেত্রী বহিষ্কার

প্রতীকী ছবি

জয়পুরহাট সদর উপজেলার মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আসমা বিবিকে দল থেকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করা হয়েছে। জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে নারী মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য আবেদন করার অপরাধে তাঁকে বহিষ্কার করা হয়। জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি রেবেকা সুলতানা ও সাধারণ সম্পাদক মাহফুজা মণ্ডল স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তি সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে জয়পুরহাট জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি রেবেকা সুলতান বুধবার দুপুরে প্রথম আলোকে বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় আসমা বিবির বয়স ছিল আট বছর। তিনি সেই সময় ২২ বছরের তরুণী ছিলেন দেখিয়ে নারী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত হওয়ার জন্য আবেদন করেছেন। নারী মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পেতে তিনি যেসব কাগজপত্র ও সনদ জমা দিয়েছেন, সেগুলো ভুয়া। কেন্দ্রীয় মহিলা আওয়ামী লীগের নির্দেশে গতকাল মঙ্গলবার আমরা দলীয় পদ ও দল থেকে তাঁকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করেছি।’

আসমা বিবি নারী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গেজেটভুক্ত হওয়ার জন্য ২০১৯ সালের ২৪ ডিসেম্বর জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলে আবেদন করেন। তিনি আবেদনে স্বামীর পরিবর্তে বাবা ইসমাইল ফকিরের নাম ব্যবহার করেছেন।

স্থানীয় সূত্র জানায়, আসমা বিবি নারী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গেজেটভুক্ত হওয়ার জন্য ২০১৯ সালের ২৪ ডিসেম্বর জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলে আবেদন করেন। তিনি আবেদনে স্বামীর পরিবর্তে বাবা ইসমাইল ফকিরের নাম ব্যবহার করেছেন। তিনি আবেদনপত্রের সঙ্গে নারী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে থানা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডারের প্রত্যয়নপত্র, ইউপি চেয়ারম্যানের প্রত্যয়নপত্র, জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডারের প্রত্যয়নপত্র জমা দিয়েছেন।

ওই আবেদনপত্রে আসমা বিবি উল্লেখ করেছেন, তিনি একজন প্রকৃত নারী মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাঁদের বাড়িতে এসে তাঁকে ধরে নিয়ে যায়। তাঁকে হানাদার বাহিনীর ক্যাম্পের বাংকারের ভেতর রেখে নির্যাতন করা হয়। মুক্তিযোদ্ধারা সশস্ত্র হামলা চালালে ক্যাম্প থেকে হানাদার বাহিনীর সদস্যরা পালিয়ে যায়। পরে তিনি সহযোগী হিসেবে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কাজ করেছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আসমা বিবির জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর ৫৫৩৬৪২১২৯৯। সেখানে তাঁর জম্মতারিখ ১৯৬২ সালের ২০ ডিসেম্বর। ওই হিসাব অনুযায়ী মুক্তিযুদ্ধ শুরুর সময় আসমা বিবির বয়স ছিল আট বছর তিন মাস ছয় দিন। ২০১৭ সালের ২০ এপ্রিল দোগাছি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও সচিবের যৌথ স্বাক্ষরে সরবরাহ করা জম্মসনদে আসমা বিবির জম্মতারিখ ২০ ডিসেম্বর ১৯৫০ সাল উল্লেখ করা হয়েছে। জম্মসনদে তাঁর বাবার নামের বদলে স্বামী আবদুস সামাদ শেখের নাম রয়েছে। এই জম্মসনদ অনুযায়ী মুক্তিযুদ্ধের সময় আসমা বিবির বয়স ছিল বিশ বছর। জম্মসনদের ভিত্তিতে জাতীয় পরিচয়পত্রে থাকা বয়স সংশোধনের জন্য তিনি নির্বাচন কমিশনে আবেদন করেছিলেন। বয়স প্রমাণ করতে তিনি উত্তর জয়পুর দাখিল মাদ্রাসা থেকে ১৯৬৩ সালে অষ্টম শ্রেণি পাস করেছেন এমন প্রত্যয়নপত্রও জমা দিয়েছিলেন। কিন্তু তথ্যে গরমিল থাকায় নির্বাচন কমিশন আসমা বিবির বয়স সংশোধনের আবেদন বাতিল করেছে।

খোঁজ নিয়ে আরও জানা যায়, ২০১৯ সালের ২৪ ডিসেম্বর তিনি নারী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গেজেটভুক্ত হওয়ার জন্য জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের মহাপরিচালকের কাছে আবেদন করেন। ওই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে কাউন্সিলের সহকারী পরিচালক আবদুল খালেক গত ২ জানুয়ারি বিশেষ কমিটির মাধ্যমে বিষয়টি যাচাই-বাছাইয়ের জন্য জয়পুরহাট সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কাছে চিঠি পাঠান। ওই চিঠি পাওয়ার পর সদরের ইউএনও মিল্টন চন্দ্র রায় উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা শাহানাজ সিগমাকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে দেন। গত ২৪ জুন এই কমিটি আসমা বিবিকে নারী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গেজেটভুক্ত করার সুপারিশ করে ইউএনওর কাছে প্রতিবেদন জমা দেয়।

এরপর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কমিটি আসমা বিবির আবেদনটি সুপারিশ করে জেলা কমিটিতে পাঠায়। ঘটনাটি জানাজানি হওয়ার পর আসমা বিবির বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসকের কাছে লিখিত অভিযোগ করেন জয়পুরহাট পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি আজম আলী। ওই অভিযোগে তিনি উল্লেখ করেন, উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কমিটি আসমা বিবিকে কোনো প্রত্যয়নপত্র দেননি বলে লিখিতভাবে জানিয়েছে।

এ বিষয়ে জয়পুরহাট পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি আজম আলী বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় আসমা বিবি শিশু ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের ৪৯ বছরে এসে আসমা বিবি নারী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি চেয়ে আবেদন করেছেন। এতে হতবাক ও বিস্মিত হয়েছি। এ কারণে আসমা বিবির বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসকের কাছে লিখিত অভিযোগ করেছি।’

মুক্তিযুদ্ধের সময় আসমা বিবি শিশু ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের ৪৯ বছরে এসে আসমা বিবি নারী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি চেয়ে আবেদন করেছেন। এতে হতবাক ও বিস্মিত হয়েছি। এ কারণে আসমা বিবির বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসকের কাছে লিখিত অভিযোগ করেছি।
আজম আলী, সভাপতি, জয়পুরহাট পৌর আওয়ামী লীগ

জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে নারী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতির জন্য আবেদন করার অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে আসমা বিবি দাবি করেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার বয়স ছিল বিশ বছর। সেই সময় পাকিস্তানি হানাদারেরা আমাকে নির্যাতন করেছে। ইউপি চেয়ারম্যান, থানা ও জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ আমাকে বীরাঙ্গনা হিসেবে প্রত্যয়নপত্র দিয়েছে। আমাকে নারী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গেজেটভুক্ত করার জন্য জামুকায় আবেদন করেছি।’

এ বিষয়ে জয়পুরহাটের জেলা প্রশাসক শরীফুল ইসলাম মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘ইতিমধ্যে আমরা সংশ্লিষ্ট মাদ্রাসা সুপার ও ইউপি চেয়ারম্যানের লিখিত ডকুমেন্ট পেয়েছি। মাদ্রাসার সুপার সেখানে বলেছেন, তাঁকে চাপ দিয়ে আসমা বিবির শিক্ষাগত যোগ্যতার প্রত্যয়ন নেওয়া হয়েছে। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বলেছেন, তাঁর অগোচরে আসমা বিবি ভুয়া জন্মসনদ নিয়েছেন।