‘মুহিতের মৃত্যুতে সিলেটবাসী কী হারাল, সেই বেদনা কেবল তাঁরাই জানেন’

সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত
ফাইল ছবি

দেশের বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ ও সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের মৃত্যু শুধু রাজনৈতিক ও প্রগতিশীল অঙ্গনের জন্যই নয়, সিলেটবাসীর জন্যও অপূরণীয় ক্ষতি বলে মনে করেন এখানকার নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ। তাঁর মৃত্যুতে সিলেটজুড়ে বইছে শোকের আবহ।

গতকাল শুক্রবার রাত ১২টা ৫৬ মিনিটে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে মারা যান আবুল মাল আবদুল মুহিত (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৮ বছর।

মুহিতের ছোট ভাই ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন প্রথম আলোকে জানান, ঢাকায় দুই দফা জানাজা শেষে বেলা দুইটায় তাঁর মরদেহ সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে নেওয়া হবে। সেখান থেকে দাফনের জন্য মরদেহ নেওয়া হবে তাঁর জন্মস্থান সিলেটে।

আবুল মাল আবদুল মুহিতের মৃত্যুর খবর জানার পর প্রথম আলো কথা বলে সিলেটের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার বিশিষ্টজনদের সঙ্গে। তাঁরা জানান, ভাষাসংগ্রামী, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, লেখক ও অর্থনীতিবিদ আবুল মাল আবদুল মুহিত ছিলেন সিলেট-অন্তঃপ্রাণ একজন মানুষ। তিনিই প্রথম ‘আলোকিত সিলেট’ গড়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন। সে অনুযায়ী সরকারিভাবে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজও সম্পন্ন করেছেন। তাঁর মৃত্যুতে সিলেটবাসী কী হারাল, এর বেদনা কেবল তাঁরাই জানেন।

সম্মিলিত নাট্য পরিষদ সিলেটের সাধারণ সম্পাদক রজতকান্তি গুপ্ত বলেন, ‘আমার দেখা শ্রেষ্ঠ মানুষ ছিলেন আবুল মাল আবদুল মুহিত। তাঁর জন্য সিলেটে আমরা চমৎকার একটা শহীদ মিনার প্রতিষ্ঠা করতে পেয়েছি। সিলেটের সংস্কৃতিচর্চাকে বিকশিত করার পেছনে তাঁর বিরাট ভূমিকা রয়েছে। কেবল সিলেট নয়, তিনি দেশের উন্নয়নেরও সিঁড়ি তৈরি করেছেন। একজন অসাম্প্রদায়িক চেতনার বাতিঘরকে আমরা হারালাম।’

আরও পড়ুন

আবুল মাল আবদুল মুহিতের দীর্ঘকালের স্নেহভাজনদের একজন মুক্তাদীর আহমদ। সমাজ অনুশীলন সিলেটের সদস্যসচিব ও সাংবাদিক মুক্তাদীর বলেন, ‘সিলেটবাসীর মুগ্ধতার প্রতীক মুহিত শুধু তাঁর নিজস্ব পরিমণ্ডলে আলো ছড়াননি; তাঁর চারপাশকেও আলোকিত করেছেন। আলোকিত সিলেটের স্বপ্নদ্রষ্টা মুহিত পরিতৃপ্ত ও সফল জীবন কাটিয়ে অনন্তের যাত্রী হলেন। তাঁর স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা। তাঁর মৃত্যুতে সিলেটবাসী গভীর ক্ষতি হলো। তবে তিনি দীর্ঘকাল বেঁচে থাকবেন তাঁর কর্মগুণে।’

সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সংস্কৃতিবিষয়ক সম্পাদক শামসুল আলম সেলিম সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটিরও সদস্য। তিনি বলেন, ‘একজন মহৎপ্রাণ ব্যক্তিকে আমরা হারালাম। আবুল মাল আবদুল মুহিতের মতো একজন সৎ, মেধাবী, আলোকিত ও সজ্জন মানুষ পেতে বাংলাদেশকে আর কতকাল অপেক্ষা করতে হবে, তা জানি না। এ এক অপূরণীয় ক্ষতি।’

উৎস প্রকাশন থেকে আবুল মাল আবদুল মুহিতের ১০ খণ্ডের রচনাবলি প্রকাশিত হয় ২০১৬ সালে। বইয়ের প্রকাশক মোস্তফা সেলিম বলেন, ‘আবুল মাল আবদুল মুহিত নানাভাবে এ দেশ ও দেশের মানুষকে এগিয়ে নিয়েছেন। তাঁর মতো প্রাজ্ঞতায় অনন্য মানুষ এ বাংলায় খুব কমই জন্ম নিয়েছেন। লেখালেখি, সাংস্কৃতিক কর্মযোগ এবং স্বদেশ-চেতনায় তাঁর কালে তাঁর তুল্য মানুষ বিরল। তাঁর রচনাবলির মাধ্যমে বাঙালির চিন্তায় তিনি চিরকাল প্রাসঙ্গিক হয়ে থাকবেন।’

জাতীয় নেতৃত্বে আবুল মাল আবদুল মুহিতের শূন্যতা অপূরণীয় বলে মনে করেন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সিলেটের সাধারণ সম্পাদক আবদুল করিম চৌধুরী কিম। তিনি বলেন, ‘মুহিত ছিলেন সিলেট বাপার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। ২০০৬ সালে সিলেটে বাপা গঠিত হয় তাঁরই হাত ধরে। তাঁর মৃত্যুতে একজন অভিভাবক হারানোর শোক অনুভব করছি।’

আরও পড়ুন

এদিকে আবুল মাল আবদুল মুহিতের মৃত্যুতে শোক জানিয়ে সিলেটের বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবী সংগঠন বিবৃতি দিয়েছে। এ ছাড়া সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষও শোক প্রকাশ করেছেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন।

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদ এক শোকবার্তায় বলেন, আবুল মাল আবদুল মুহিত অত্যন্ত সজ্জন ব্যক্তি ছিলেন। তিনি আজীবন দেশ ও মানুষের সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করেছেন।

সিলেটের মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান তৌফিক রহমান চৌধুরী ও উপাচার্য মো. সালেহ উদ্দিন শোক প্রকাশ করে বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতিকে দৃঢ় ভিত্তি দিতে আবুল মাল আবদুল মুহিত ছিলেন অগ্রণী ভূমিকায়।

আরও পড়ুন

আবুল মাল আবদুল মুহিত ১৯৩৪ সালের ২৫ জানুয়ারি সিলেট শহরের ধোপাদীঘিরপাড়ে জন্মগ্রহণ করেন। তৎকালীন সিলেট জেলা মুসলিম লীগের কর্ণধার আবু আহমদ আবদুল হাফিজ ও সৈয়দা শাহার বানু চৌধুরীর ১৪ সন্তানের মধ্যে তৃতীয় সন্তান মুহিত। স্ত্রী সৈয়দা সাবিয়া মুহিত একজন ডিজাইনার। তিন সন্তানের মধ্যে মেয়ে সামিনা মুহিত ব্যাংকার ও আর্থিক খাতের বিশেষজ্ঞ। বড় ছেলে সাহেদ মুহিত বাস্তুকলাবিদ এবং ছোট ছেলে সামির মুহিত শিক্ষক।

যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে উচ্চতর ডিগ্রি নেওয়া আবুল মাল আবদুল মুহিত বরাবরই একজন মেধাবী মানুষ ছিলেন। ১৯৫৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক (সম্মান) পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করেন তিনি। পরের বছর একই বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। এর আগে অংশ নেন ভাষা আন্দোলনে। ছাত্রজীবনে সলিমুল্লাহ হল ছাত্র সংসদের ভিপি নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। মহান মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসে সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন।

আরও পড়ুন