‘মেয়েটা থাকলে কত কেনাকাটা করত’

গত বছর ঈদে আফরিন নিজেই পছন্দ করে জামা কিনেছে। এবার ঈদে বাড়ির কেউ কিছু কেনেনি।

আফরিনের মা–বাবার মনে নেই ঈদের খুশি। গতকাল শনিবার
প্রথম আলো

‘বাড়ির আশপাশের সব মানুষ বাচ্চাদের নিয়ে ঈদের কাপড়চোপড় কেনাকাটা করছে। অথচ মেয়েটা আমার বেঁচে নেই। মানুষজন কাপড়চোপড় কিনছে, আর কষ্টে আমার বুকটা ফেটে যাচ্ছে। মেয়েটা থাকলে কত কেনাকাটা করত। ওর মুখে আনন্দ, খুশি থাকত। আর ও এত সুন্দর করে মা–বাবা ডাকত, এটা শুনলেই প্রাণ ভরে যেত।’ বুকফাটা কান্নায় কথাগুলো বলছিলেন আফরিন হকের মা মাসুরা বেগম।

আফরিন হকের (৮) চলে যাওয়ার এক মাস হলো আজ রোববার (১ মে)। গত ৩০ মার্চ সকালে বাবার সঙ্গে মোটরসাইকেলে করে স্কুলে যাওয়ার পথে রাজশাহী নগরের খড়খড়ি বাইপাসের বামনশিখড় এলাকায় ট্রাকচাপায় আহত হয় আফরিন। তার ডান পায়ের ওপর দিয়ে ট্রাকটি চলে যায়। আফরিনকে বাঁচাতে তার ডান পা কাটা হয়। এরপরও তাকে বাঁচানো যায়নি। ৩১ মার্চ ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে সে মারা যায়। আফরিন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় স্কুলের প্রথম শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল। তার বাবা আজিজুল হক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকাশনা দপ্তরের অফিস সহায়ক।

প্রতিটি মুহূর্তে আফরিনের মুখ আমার চোখে ভাসে। কেউ কারও ব্যথা বোঝে না। মা বোঝে সন্তান হারানো কত কষ্টের।
মাসুরা বেগম, আফরিনের মা
আফরিন হক

পবা উপজেলার পারিলা ইউনিয়নের হাটরামচন্দ্রপুর বাজার ঘেঁষে আফরিনদের বাড়ি। গতকাল শনিবার সকালে গিয়ে দেখা যায়, আফরিনের মা ছোট মেয়ে মেহজাবিন হককে (৪ মাস) ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করছেন। বাড়িঘর একদম সুনসান।

মা মাসুরা বলেন, প্রতিটি মুহূর্তে আফরিনের মুখ তাঁর চোখে ভাসে। কেউ কারও ব্যথা বোঝে না। মা বোঝে সন্তান হারানো কত কষ্টের। আফরিন রমজানে বিরিয়ানি খেতে চাইত। মৃত্যুর আগে বলেছিল তরমুজ খাবে। কিন্তু তখন আর খাওয়ানো যায়নি। বাড়িতে সবাইকে নিয়ে এক জায়গায় ইফতার করা হয়। সবাই আছে, শুধু মাঝখান থেকে আফরিন নেই।

দুর্ঘটনার দিনের কথা স্মরণ করে মাসুরা বলেন, ‘৩০ মার্চ পোশাকআশাক পরিয়ে আফরিনকে রাস্তার ওপারে দিয়ে আসলাম। ও ওর বাবার মোটরসাইকেলের পেছনে উঠে বসল। পেছনে তাকিয়ে এমন সুন্দর একটা হাসি দিল। ওটাই ছিল ওর শেষ হাসি। তার ১০ মিনিট পরই শুনলাম, ও দুর্ঘটনায় পড়েছে। হাসপাতালে যাওয়ার পর ও আমাকে এমন করে ধরে চুমু খেল। আর বলল, “মা, আমি ভালো হয়ে যাব”।’

আলাপের মধ্যেই আফরিনের খেলনা বের করা হলো। আফরিন যেসব পোশাক পরত, সেগুলো দেখাতে দেখাতে বাবা আজিজুল হক বলেন, ‘বেটি ছাড়া ঈদ ভালো কাটে? বেটিই তো সবকিছু ছিল।’ গত বছর আফরিন নিজেই পছন্দ করে জামা কিনেছে। এবার ঈদে বাড়ির কেউ কিছু কেনেনি। এমনকি ছোট বাচ্চা মেহজাবিনের জন্যও কেনা হয়নি।

দুর্ঘটনার পরদিন ৩১ মার্চ নগরের মতিহার থানায় বাদী হয়ে মামলা করেছিলেন আফরিনের দাদা আবদুস সাত্তার। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, একটা মাস চলে গেল। অথচ পুলিশ আসামি ধরতে পারল না। ছোট মানুষ বলে কি পুলিশ দাম দিচ্ছে না। আফরিনকে ছাড়া কেমন লাগে জানতে চাইলে বলেন, ‘আমার মা–বাবা মারা গেছেন। তখনো এতটা কষ্ট পাইনি। নাতিপুতির একটা যে ডাক, সেটা আর শুনি না।’

নগরের মতিহার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আনোয়ার আলী বলেন, তাঁরা আসামি শনাক্ত করেছেন। তাঁদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।