যেভাবে মুক্তি পেল খাঁচার ডাহুক

প্রাকৃতিক জলাভূমি, গাছপালা কমে যাওয়াসহ শিকারের ডাহুক এখন কমে গেছে
ছবি: প্রথম আলো

সকাল সাতটা। মৌলভীবাজার শহরের কুসুমবাগ এলাকায় একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশাতে উঠলেন এক ব্যক্তি। তিনি খাঁচার মতো কিছু একটা কাপড় দিয়ে ঢেকে রেখেছেন। বাঁশ ও জালের তৈরি আরও একটা জিনিস আছে। দেখতে অনেকটা প্রসাধনীপণ্য ঝুলিয়ে রাখার অস্থায়ী তাকের মতো। প্রাথমিকভাবে মনে হলো ওই ব্যক্তি প্রসাধনী–অলংকারের ফেরিওয়ালা।

তবে মৌলভীবাজার-শেরপুর আঞ্চলিক সড়ক ধরে কিছু দূর যাওয়ার পর খাঁচার তথ্যটি বেরিয়ে এল। জানা গেল, ওই খাঁচায় একটি ডাহুক পাখি আছে। আর বাঁশ ও জাল দিয়ে তৈরি জিনিসটি পাখি শিকারের ফাঁদ। মূলত পোষা ডাহুক দিয়ে বুনো ডাহুক শিকারে যাচ্ছেন ওই ব্যক্তি। কিছু দূর গিয়ে খাঁচার মালিকের সঙ্গে আলাপ জমানোর পর জানা গেল, তিনি আসলে ফেরিওয়ালা নয়। তাঁর নাম আলতাফ আলী। গতকাল রোববার সকালে আলতাফ আলীর সঙ্গে দেখা হয়েছিল।

আলতাফ আলী মৌলভীবাজার শহরের বড়হাট এলাকায় থেকে মাটি কাটাসহ দিনমজুরের কাজ করেন। তিনি জানালেন, গতকাল কোনো কাজ নেই। তাই এই সুযোগে তিনি বুনো ডাহুক শিকার করতে বেরিয়েছেন। কাজীরবাজার নেমে পাখি শিকার করতে যাবেন। তিনি পাখি বিক্রি করেন না বলেই দাবি করলেন। শিকার করতে পারলে একবেলা পাখির মাংস খাওয়াই তাঁর উদ্দেশ্য।

এ সময় অটোরিকশায় সঙ্গে জাবেদ ভূঁইয়া নামে তরুণ কবিও ছিলেন। দুজন মিলে আলতাফ আলীকে বলা হলো, এভাবে পাখি পোষা, পাখি শিকার এবং পাখির মাংস খাওয়া বন্য প্রাণী সংরক্ষণ আইনে নিষিদ্ধ। পাখি ক্ষতিকর পোকা-মাকড় খেয়ে শস্যকে সুরক্ষা দেয়। মানুষের খাদ্য নিরাপত্তাকে সুরক্ষিত করে। পাখি কমে যাওয়ায় শস্যে পোকামাকড়, কীটপতঙ্গের উপদ্রব বেড়েছে। পোকা দমনে কীটনাশকের ব্যবহার বেড়েছে। আর কীটনাশক নানাভাবে স্বাস্থ্যের ক্ষতি করছে। প্রকৃতিতে পাখির অবাধ বিচরণ থাকলে এত পোকামাকড় বাড়ত না। পরিবেশ-প্রকৃতির ভারসাম্য ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় মানুষের জীবনে নানারকম দুর্যোগ বাড়ছে। এ ছাড়া পাখি একটি মুক্ত প্রাণী। তাঁর সন্তান বা তাঁকে যদি এভাবে খাঁচায় আটকে রাখা হতো, তাহলে তাঁরও নিশ্চয় ব্যাপারটা ভালো লাগত না।

আলতাফ আলীকে আর কিছু বলতে হয়নি। খুব সহজ-সরলভাবেই তিনি জানালেন, তিনি দিনমজুর। এত কিছু জানেন না। তিনি দেখে এসেছেন এভাবেই পোষা ডাহুক দিয়ে বনের ডাহুককে শিকার করা হয়। তাই তিনিও খাওয়ার জন্য মাঝেমধ্যে পাখি শিকার করেন। পাখি মানুষের উপকার করে, সেটা তিনি কখনো ভেবে দেখেননি।

আলতাফ আলী পরে নিজের ভুল বুঝতে পেরে পাখিটি মুক্ত করে দিয়েছেন
ছবি: প্রথম আলো

এরপর আলতাফ আলীকে ডাহুকটি মুক্ত করে দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানালে অকপটে বিষয়টি মেনে নিলেন। নিজে থেকেই জানালেন, তিনি আর শিকারে যাবেন না। তিনি তাঁর বাসার কাছে মনু নদের পাড়ের ঝোপে ডাহুকটিকে ছেড়ে দিবেন। পরে সেটাই করেছেন। কাজীরবাজার নেমে আর শিকারে যাননি। সেখান থেকে বড়হাটের বাসায় ফিরে আসেন। তৎক্ষণাৎ মনু নদের পাড়ের ঝোপে প্রতিবেশীদের সামনে ডাহুকটিকে খাঁচা খুলে মুক্ত করে দেন আলতাফ আলী। পরে খাঁচা ও ফাঁদ দুটোই ভেঙে ফেলেন।

আলতাফ আলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আপনারা যেভাবে বলেছেন, আমার বাচ্চাকাচ্চার কথা বলেছেন। আমার আর পাখির দরকার নেই। আমি সেখানে (কাজীরবাজার) চা স্টলে এক কাপ চা খেয়ে সঙ্গে সঙ্গেই চলে আসছি। এসে সবার সামনে নদীর পাড়ে পাখিটারে ছাড়ছি। পাখি শিকার করিত আর আমার জীবন চলত না। কাম করিই খাওয়া লাগব।’

পাখি বিশেষজ্ঞদের সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ, ভারত এবং দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ডাহুকের দেখা পাওয়া যায়। ডাহুক মূলত গ্রীষ্মমণ্ডলীয় এলাকার জলাভূমির পাখি। বয়সী পাখির ওজন হয় ১৯০ গ্রাম। সদ্যোজাত ছানার ওজন হয় গড়ে ৮ গ্রাম। ডাহুকের মূল খাদ্য জলজ কচি ঘাসের ডগা-পাতা, পাকা ধান ইত্যাদি। ডিম পাড়ে পাঁচ-সাতটি। ফোটে ২০-২৪ দিনে। এককালে পোষা ডাহুক দিয়ে বুনো ডাহুক শিকার করা হতো গ্রামবাংলায়। শিকারি ডাহুক চড়া মূল্যে বিক্রি হতো। প্রাকৃতিক জলাভূমি, গাছপালা কমে যাওয়াসহ শিকারের ডাহুক এখন কমে গেছে। আন্তর্জাতিক প্রকৃতি সংরক্ষণ সংস্থাগুলোর সংগঠন (আইইউসিএন) ডাহুককে ন্যূনতম বিপদগ্রস্ত তালিকাভুক্ত করেছে। বন্য প্রাণী আইনে এই পাখি সংরক্ষিত।