রাজকুমারের ভাত জোটে বাঁশি বাজিয়ে
বুকের ওপর কাগজে লেখা ‘আমি রাজকুমার (অন্ধ)। বাঁশি বাজিয়ে জীবিকা নির্বাহ করি। তাই আমাকে সাহায্য করুন।’ লাঠিতে ভর করে সড়কের পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বাঁশিতে সুর তোলেন। সুরের মূর্ছনায় লোকজনের নজর কাড়েন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী রাজকুমার।
রাজকুমারের বয়স ৫৮ বছর। বিয়ে করেননি। দুই চোখে দেখতে পারেন না বলে চলার সঙ্গী তাঁর লাঠি। তাঁর বাঁশির সুরে মুগ্ধ হয়ে, যে যা পারেন তাঁকে দান করেন। আর এতে তাঁর জোটে খাবার। এভাবেই চলে প্রতিদিন।
প্রমিত উচ্চারণে সব সময় কথা বলেন রাজকুমার। একেক জায়গায় রাস্তার পাশে কিংবা জনবহুল এলাকার মোড়ের এক কোণে দাঁড়িয়ে বাঁশিতে গানের সুর তুলে সবাইকে আকৃষ্ট করতেন। এখন আগের মতো শক্তি-সামর্থ্য নেই। তাই প্রতিদিন তাঁকে দেখা যায় মুন্সিপাড়া মোড়ে।
রাজকুমারের বাড়ি রংপুর শহরের রামপুরা এলাকার ডাক্তারপাড়ায়। ছয় বছর বয়সে বাবা ব্রজেন রায় এবং পরের বছর মা মারা যান। বিয়ের কথা এবং পরিবারের কারা আছেন জানতে চাইলে তিনি এড়িয়ে বলেন, ‘থাক ওসব কথা।’ বললেন, ‘আমি আমাকে নিয়ে আছি। বাঁশির সুরে জীবন চলছে।’
দুই চোখ নষ্ট হওয়ার ঘটনা জানতে চাইলে রাজকুমার কাঁপা কাঁপা স্বরে বলেন, ‘১৯৭১ সালের যুদ্ধের সময় আমি তখন তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ি। ওই সময় গোলাবারুদের গ্যাসে চোখ অনবরত চুলকাতে চুলকাতে লাল হয়ে যায়। ওষুধ দিয়েও ভালো হয় না। এরপর আস্তে আস্তে দুই চোখে কম দেখতে থাকি। একসময় আর দেখতে পারি না।’ এসব কথা বলতে গিয়ে তিনি আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। কিছুক্ষণ থেমে বাঁশিতে ভাওয়াইয়া গানের সুর তোলেন, ‘ও মোর কালারে কালা’।
রাজকুমার বলেন, বাঁশি শুনে যে যাঁর মতো আর্থিক সাহায্য করেন। এতে যে খুব বেশি টাকা উপার্জন হয়, তা-ও নয়। দুই বেলা খাবারের জন্য তাঁর এই ছুটে চলা। বাঁশিতে সুর তোলা। পথচারীদের মনোযোগ আকর্ষণ করার চেষ্টা করেন। কখনো একবেলা, আবার কখনো এরও কম সময় বাঁশিতে সুর তোলেন। কেননা দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে এভাবে বাঁশি বাজানোও খুব কষ্টের ব্যাপার। আবার প্রতিদিনও যে সম্ভব, তা-ও নয়। বাঁশির সুর তোলা শরীর-মনের ওপর নির্ভর করে।
বৃহস্পতিবার বিকেলে মুন্সিপাড়া কেরামতিয়া স্কুল মোড়ে বাঁশিতে সুর তুলে গান গাওয়ার এক ফাঁকে এসব কথা বলতে বলতে কেঁদে ফেলেন রাজকুমার। তাঁর শখ ছিল বাঁশি বাজানো। তাই ছোটবেলা থেকে বাঁশিতে সুর তুলতেন। দুই চোখ দিয়ে কিছু দেখতে না পেলেও বাঁশির সুরে লোকজনের মন জয় করে চলেছেন। এ থেকে লোকজনে যে টাকাপয়সা দেন, তা দিয়ে চাল কেনেন, পেটে খাবার জোটে। এরপর রাজকুমার যেতে যেতে বাঁশিতে সুর তুললেন ‘ও কি গাড়িয়াল ভাই, হাঁকাও গাড়ি তুই চিলমারী বন্দরে...।’