টোপ পার্টি
রাজনীতিকদের প্রশ্রয়ে বেপরোয়া
মাগুরার শ্রীপুর উপজেলার গড়াই নদঘেঁষা চর মহেশপুর গ্রামটিতে ডিজিটাল প্রতারক চক্র বা টোপ পার্টির দাপট সবচেয়ে বেশি।
‘টোপ পার্টি নিয়ে মুখ খোলার সাহস কারও নেই। আপনাগের (সাংবাদিকদের) আসতে দেখে সাত–আটটা মোটরসাইকেল কেবল নদীর দিক চলে গেল। উরাই এ জাগায় শক্তিশালী। অবৈধ পয়সার দাপট, নেতাগের সাপোর্ট সবই আছে ওগের। কিডা কতা কয়ে মার খাবি?’
ডিজিটাল প্রতারক চক্র বা টোপ পার্টি নিয়ে প্রশ্ন করলে নিচু স্বরে কথাগুলো বললেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মাগুরার শ্রীপুর উপজেলার চর মহেশপুর গ্রামের এক চাষি। গত মঙ্গলবার দুপুরে গ্রামের দ্বীপচর এলাকায় কথা হয় ওই কৃষকের সঙ্গে।
স্থানীয় বাসিন্দা ও পুলিশের ভাষ্য, মাগুরার গড়াই নদঘেঁষা গ্রামটিতে প্রতারক চক্রের দাপট সবচেয়ে বেশি। কেউ কেউ বলছেন, এ এলাকার ৯০ ভাগ পরিবারের সদস্য প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এ চক্রের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন। সেখানে ঢাল হিসেবে আছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও ক্ষমতাসীন দলের নেতারা। যদিও অভিযুক্ত ব্যক্তিরা সবাই অভিযোগ অস্বীকার করছেন।
এঁদের (টোপ পার্টি) নিয়ে কথা বলার উপায় নাই। আমার জীবনটাই হুমকির মুখে। এরা হুমকি দেয়, একজনকে খুন করতে কত টাকা লাগে? আমাদের দলের কেউ কেউ যে এর সাথে যুক্ত, এটাও অস্বীকার করার উপায় নাই।আওয়ামী লীগ নেতা জিয়ারুল শেখ
মহেশপুর গ্রামে যাঁরা শুরুর দিকে এ প্রতারণার সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তাঁদের একজন ছামাদ আলী মন্ডল (২৮)। এলাকায় টোপ পার্টির প্রশিক্ষক হিসেবে পরিচিত এই তরুণ। তাঁর নামে ঢাকার কাফরুল থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা আছে। অভিযোগ রয়েছে, এলাকায় প্রতারকদের একটি দলের নেতৃত্ব দেন তিনি। মঙ্গলবার তিনি মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আগে একসময় করতাম। মামলা খাওয়ার পর ছেড়ে দিয়েছি। এখন পানের বরজ নিয়ে আছি।’ পুলিশ ও স্থানীয়দের ভাষ্য, ওই তরুণ দ্বারিয়াপুর ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য ওয়াজেদ আলী মন্ডলের ছত্রচ্ছায়ায় থাকেন।
রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দি থানার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের একটি মামলার আসামি মহেশপুর গ্রামের সুজন শেখ (২৫)। মধুখালীর ডুমাইন এলাকা থেকে প্রতারণার কৌশল শিখে শুরুর দিকে এলাকায় এ কাজ শুরু করেন তিনি। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মহেশপুর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জিয়ারুল শেখের ভাগনে এই তরুণ। স্থানীয় ব্যক্তিরা জানান, ইউপি সদস্য ওয়াজেদ আলী মন্ডল ও আওয়ামী লীগ নেতা জিয়ারুল শেখ গ্রামের দুটি পক্ষের নেতৃত্ব দেন। তাঁরা ছাড়াও ওই গ্রামে যেসব পক্ষের নেতারা আছেন, তাঁদের ছত্রচ্ছায়ায় টোপ পার্টি ক্রমেই বেপরোয়া হয়ে উঠছে। অনেকের পরিবারের সদস্যরাও এ কাজের সঙ্গে যুক্ত বলে অভিযোগ রয়েছে।
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগ নেতা জিয়ারুল শেখ প্রথম আলোকে বলেন, ‘এঁদের (টোপ পার্টি) নিয়ে কথা বলার উপায় নাই। আমার জীবনটাই হুমকির মুখে। এরা হুমকি দেয়, একজনকে খুন করতে কত টাকা লাগে? আমাদের দলের কেউ কেউ যে এর সাথে যুক্ত, এটাও অস্বীকার করার উপায় নাই।’
আর ইউপি সদস্য ওয়াজেদ আলী মন্ডল বলছেন, ‘টোপ পার্টির সমস্যা পনেরো আনা সমাধান হয়ে গেছে। মামলা খেয়ে বেশির ভাগই ভালো হয়ে গেছে। এখন যা শোনা যায়, ওপারের (বালিয়াকান্দি) লোকজন টোপ মারে আর মহেশপুরের মানুষের নাম হয়।’
উপজেলার শ্রীকোল ইউনিয়নের বরিশাট এলাকায় টোপ পার্টির মূল হিসেবে যাঁদের নাম শোনা যায়, তাঁদের একজন সোহেল রানা ওরফে জনি শেখ। চলতি বছরের শুরুর দিকে ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতির দায়িত্ব পেয়েছেন তিনি। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ কয়েকজনের অভিযোগ, বরিশাটে টোপ পার্টির যে কয়েকটি দল রয়েছে, তার একটির নেতৃত্ব দেন জনি। অবশ্য এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন স্বেচ্ছাসেবক লীগের ওই নেতা। তিনি মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে যে বা যাঁরা এ অভিযোগ দিয়েছেন, তা শত্রুতা থেকে। আমার বাড়ি আসলে ও চালচলন দেখলে বোঝা যাবে আমি এর সাথে যুক্ত নই।’
স্থানীয়দের অভিযোগ, রাজনৈতিক নেতাদের পাশাপাশি পুলিশের কাছেও অনুকম্পা পাচ্ছে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা। যে কারণে দিন দিন টোপ পার্টির দৌরাত্ম্য বাড়ছে। দীর্ঘদিন এ ধরনের প্রতারক চক্র নিয়ে কাজ করা কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কয়েকটি কারণে এ অপরাধ দমন করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। সেগুলো হচ্ছে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা এখান থেকে প্রতারণা করলেও ভুক্তভোগী থাকছেন দেশের অন্য প্রান্তে। ফলে স্থানীয় থানায় অভিযোগ আসছে কম। এ ধরনের মামলায় আসামিরা সহজেই জামিন পেয়ে যাচ্ছেন।
জানতে চাইলে মাগুরার পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, মোবাইল ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানগুলোকে একটি অ্যাকাউন্টের একাধিক অ্যাপে লগইন করার পথ বন্ধ করতে হবে। অর্থাৎ একটি অ্যাকাউন্টে যেন একাধিক মোবাইল বা অ্যাপ দিয়ে প্রবেশ করা না যায়। এটা হলে প্রতারণার ৯০ ভাগ পথ বন্ধ হয়ে যাবে।