রাত যত গভীর হয়, মমতাজ বেগমের ব্যস্ততা তত বাড়ে
গত শনিবার দিবারাত দেড়টার দিকে গাজীপুর শহরের রাজবাড়ি সড়ক বেশ নির্জন। দিনের চিরচেনা যানবাহনের কোলাহল, মানুষের হাঁকডাক কিছু নেই। সড়কবাতির আলোয় যত দূর চোখ যায়, কেবল শূন্যতা। শূন্যতা আর অন্ধকার মিলেমিশে অনেকটা ভুতুড়ে পরিবেশ। এমন নির্জনতার মধ্যে সড়কের জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয়ের সামনে দেখা মিলল এক বৃদ্ধ নারীর। হাতে ঝাড়ু আর ময়লা ফেলার ট্রলি। পরিচ্ছন্নতাকর্মী এই নারী ঝাড়ু দিয়ে সড়কে পড়ে থাকা ময়লাগুলো তুলছেন ট্রলিতে। এরপর ট্রলি ঠেলে সেসব ময়লা নিয়ে জমা করছেন একটি নির্দিষ্ট স্থানে।
পরিচয় দিয়ে কথা হয় ওই নারীর সঙ্গে। তাঁর নাম মমতাজ বেগম (৬১)। বাসা নগরের কাজীবাড়ি এলাকায়। স্বামী অসুস্থ। দুই ছেলে। ছোট ছেলে পড়াশোনা করে। বড় ছেলে কাঁচামালের ব্যবসা করেন। বড় ছেলের একার আয়ে সংসার চলে না, তাই তিনিও কাজ করছেন সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মীর। সবাই যখন ঘরে ফেরায় ব্যস্ত, নগরের রাস্তাঘাটগুলো যখন ফাঁকা, তখন সড়কে চলছিল তাঁর জীবনযুদ্ধ। রাত যত গভীর হচ্ছিল, ততই বাড়ছিল তাঁর ব্যস্ততা।
মমতাজ বেগমের বেতন ৯ হাজার ৯০০ টাকা। বড় ছেলের আলাদা সংসার। তাঁর তিন ছেলেমেয়ে। তবে তাঁরা একই বাসায় থাকেন। কাঁচামালের ব্যবসা করে বড় ছেলের যে আয়, তাতে তিনি নিজেই চলতে পারেন না। এ কারণে ঘরভাড়ার ৬ হাজার ৫০০ টাকা দেন মমতাজ বেগম। বাকি ৩ হাজার ৪০০ টাকায় টেনেটুনে চলে সংসার। এর মধ্যে ছোট ছেলের লেখাপড়া ও অসুস্থ স্বামীর ওষুধের খরচ জোগাতে প্রতি মাসেই তাঁকে হাত পাততে হয় মানুষের কাছে।
মমতাজের ভাষায়, ‘সপ্তাহে পোলার বাপের পেছনে ৬০০ ট্যাকার ওষুধ লাগে। আবার ছোড পোলাডাও লেহাপড়া করে। তার পেছনেও একটা খরচ আছে। সব মিলায়া যা ইনকাম করি, তার সবই সংসারের পেছনে যায়। নিজের শখ-আহ্লাদ বইল্যা কিছু নাই। নিজে অসুস্থ হইলেও ওষুধ খাওয়ার ট্যাকা থাকে না।’
মিনিট দশেক কথা বলার পর মমতাজ বেগম আবার কাজে নেমে পড়েন। সকাল হওয়ার আগেই তাঁকে পুরো সড়ক (রাজবাড়ি ঢাল থেকে কেন্দ্রীয় মসজিদ পর্যন্ত) পরিষ্কার করতে হবে। তবে যাওয়ার আগে তিনি বলে যান, ‘এই যে প্রতিদিন সক্কালবেলা রাস্তাঘাট পরিষ্কার দ্যাহেন, আরাম কইরা হাঁইটা যান, এগুলা সব আমাগোর লাইগ্যা। আমরা যদি এক দিন কামে না আহি, তাইলে দেখবেন শহরের কী অবস্থা অয়! রাস্তাঘাট ময়লা-আর্জনায় ভইরা যাইবো। তহন শহরে থাহার সুখ কী জিনিস, সেইডা খুঁইজা পাইবেন না।’
১০ বছর ধরে এই কাজ করছেন মমতাজ বেগম। এত দিন কাজ করে কী পেলেন? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কিছুই না। খালি বেতনডাই পাই। এর বাইরে কোনো সুযোগ-সুবিধা নাই। এই বেতনে কোনোরকমে টেনেটুনে সংসার চলে। কোনো মাসে টাকার টান পড়লে পুরা পরিবারে হাহাকার দেখা দেয়। কিন্তু কেউ একবার জিগ্যায়ও না। করোনার সময়ডাতে পরিবার নিয়া যা কষ্ট করছি, তা আর বলতে নাই। পোলাডার কাম বন্ধ হইয়্যা গেছিল, কোনো আয়রোজগার ছিল না। হেই লাইগ্যা ঘরে খাওন ছিল না। খাবারের লাইগ্যা স্টেশনে স্টেশনে ঘুরছি, কেউ এক বেলা খাবার দেয় নাই।’