উপাচার্যের বিদায়ের দিনে নানা রকম আনুষ্ঠানিকতা থাকে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আবদুস সোবহানের বিদায়বেলায় তার ছিটেফোঁটাও ছিল না। বরং তাঁকে পুলিশি পাহারায় ক্যাম্পাস ছাড়তে হয়েছিল। তাঁর বিদায়ে মেলেনি একটি ফুলও। উপাচার্যের এমন বিদায় ছিল সারা দেশে আলোচিত।

উপাচার্য আবদুস সোবহানের শেষ কর্মদিবস ছিল চলতি বছরের ৬ মে। এদিন তিনি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অগ্রাহ্য করে ১৩৮ জনকে নিয়োগ দিয়ে যান। এই নিয়োগ কেন্দ্র করেই বিশ্ববিদ্যালয় ও মহানগর ছাত্রলীগ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। এই নিয়োগপত্রে নিয়ম অনুযায়ী, রেজিস্ট্রারের স্বাক্ষরও ছিল না। রেজিস্ট্রার ছিলেন আত্মগোপনে। অন্য একজন সহকারী রেজিস্ট্রারকে দিয়ে নিয়োগপত্রে স্বাক্ষর করানো হয়। উপাচার্য তাঁর আপন ও কাছের মানুষ থেকে শুরু করে বাড়ির নাপিত-কাঠমিস্ত্রিকে পর্যন্ত চাকরি দিয়ে যান। তবে সেই চাকরিতে এখনো তাঁরা যোগদান করতে পারেননি।

বিদায়ের আগে-পরে কী ঘটেছিল

অধ্যাপক আবদুস সোবহান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয় মেয়াদে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পান ২০১৭ সালের ৬ মে। তিনি উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পরই শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালা শিথিল করে মেয়ে, জামাতাসহ বেশ কয়েকজনকে চাকরি দেন। এ নিয়ে তখন থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ে সাবেক উপাচার্য মিজান উদ্দিনপন্থী শিক্ষকেরা আপত্তি জানিয়ে আন্দোলন করে আসছিলেন। ২০২০ সালে তাঁদের আন্দোলন জোরদার হয়। ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে শিক্ষক সমাজ’ ব্যানারে শিক্ষকদের একাংশ ওই বছরের ৪ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দুর্নীতির তথ্য-উপাত্তসংবলিত ৩০০ পৃষ্ঠার অভিযোগ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, দুর্নীতি দমন কমিশন ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনে (ইউজিসি) দেন।

পরে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে অভিযোগ তদন্তে ইউজিসি একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে তদন্ত কমিটি উভয় পক্ষের বক্তব্য উপস্থাপনে উন্মুক্ত শুনানির আয়োজন করে। কিন্তু ইউজিসির বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ তুলে উপাচার্য সোবহান তাতে হাজির হননি।

তদন্ত শেষে গত ২১ অক্টোবর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে সুপারিশসহ তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয় ইউজিসি। পরে ১০ ডিসেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয় এক চিঠিতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সব নিয়োগ স্থগিত করে। তবে এই নিষেধাজ্ঞা অগ্রাহ্য করে শেষ দিনে হুলুস্থুল পরিস্থিতির মধ্যে ১৩৮ জনকে নিয়োগ দেন। ওই দিন দুপুরে তিনি পুলিশি পাহারায় ক্যাম্পাস ত্যাগ করেন। সেদিনই শিক্ষা মন্ত্রণালয় এই নিয়োগকে অবৈধ ঘোষণা করে তদন্ত কমিটি গঠন করে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় গঠিত তদন্ত কমিটি গত ২৩ মে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়। ওই তদন্ত প্রতিবেদনেও এই নিয়োগকে ‘সম্পূর্ণ অবৈধ’ উল্লেখ করা হয়। নিয়োগটি বাতিল করা এবং উপাচার্যসহ দায়ীদের শাস্তির সুপারিশও করা হয়েছিল কমিটির পক্ষ থেকে। তবে এখনো এ বিষয়ে দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা নেয়নি শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

তবে গত ২৮ জুন শুধু আহ্বায়ক পরিবর্তন করে অধিকতর তদন্তে পুনরায় তদন্ত কমিটি গঠন করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এবার আহ্বায়ক করা হয় ইউজিসির সদস্য অধ্যাপক দিল আফরোজা বেগমকে। তবে এ বিষয়ে সর্বশেষ অগ্রগতি সম্পর্কে জানা সম্ভব হয়নি।

নিয়োগ টিকবে, নাকি বাতিল হবে

উপাচার্যের শেষ দিনে নিয়োগপ্রাপ্ত ১৩৮ জনের অনেকেরই যোগদানে এখনো আশা রয়েছে। তাঁরা মনে করেন, উপাচার্য আইন অনুযায়ী তাঁদের নিয়োগপত্র দিয়ে গেছেন। তাই তাঁদের অবৈধ বলার কোনো কারণ নেই।

তবে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ১৩৮ জনের নিয়োগের পর থেকেই আলোচনা রয়েছে, এই নিয়োগ টিকবে না। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক দুলাল চন্দ্র বিশ্বাস প্রথম আলোকে বলেন, সাবেক উপাচার্য যেভাবে নীতি বিসর্জন দিয়ে নিয়োগ দিয়ে গেছেন, তা শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ সবাইকে একটা লজ্জার মধ্যে ফেলেছে।