রোহিঙ্গাদের এনআইডি দিয়ে লাখপতি ইসির পিয়ন

জয়নাল আবেদীন নির্বাচন কার্যালয়ের অফিস সহায়ক (পিয়ন)। তাঁর স্ত্রী আনিছুন নাহার গৃহিণী। দুজনের বিকল্প আয়ের বৈধ কোনো উৎস নেই। অথচ তাঁরা লাখপতি। দুজনের নামে রয়েছে পাঁচতলা বাড়ি ও জমি। ব্যাংক হিসাবে জমা রয়েছে লাখ টাকা। সব মিলিয়ে দুজনের অবৈধ সম্পদের পরিমাণ পৌনে এক কোটি টাকা।

চট্টগ্রাম নগরের ডবলমুরিং থানা নির্বাচন কার্যালয়ের বরখাস্ত হওয়া অফিস সহায়ক জয়নাল আবেদীনের বিরুদ্ধে করা মামলার তদন্তে এসব তথ্য পায় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তদন্তে উঠে এসেছে, জয়নাল ও তাঁর স্ত্রীর লাখপতি হয়েছেন রোহিঙ্গাদের টাকার বিনিময়ে জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) করে দিয়ে। জয়নাল স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতেও তা স্বীকার করেছেন।

দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে গত সোমবার জয়নাল ও তাঁর স্ত্রী আনিছুন নাহারকে আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দিয়েছে দুদক।
দুদকের আইনজীবী মাহমুদুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ২১ সেপ্টেম্বর অভিযোগপত্রটি গ্রহণের শুনানির জন্য জেলা ও দায়রা জজ আদালতে দিন ধার্য রয়েছে। জয়নালের বিরুদ্ধে আরও তিনটি এবং তাঁর স্ত্রীর বিরুদ্ধে একটি মামলা তদন্তাধীন রয়েছে। জয়নাল জামিনে থাকলেও তাঁর স্ত্রী পলাতক।

এনআইডি জালিয়াতি ধরা পড়ে ২০১৯ সালের ২২ আগস্ট। সেদিন লাকী নামের এক নারী চট্টগ্রাম জেলা নির্বাচন কার্যালয়ে স্মার্ট কার্ড তুলতে গেলে কর্মকর্তাদের সন্দেহ হয়। পরে জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসে, ওই নারী রোহিঙ্গা এবং টাকা দিয়ে এনআইডি করিয়েছেন। বিষয়টি নিয়ে তখন প্রথম আলোয় প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এ ঘটনায় জয়নালসহ অন্যরা জড়িতে বলে জানতে পারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ওই বছরের ১৬ সেপ্টেম্বর নির্বাচন কমিশনের (ইসি) একটি ল্যাপটপসহ জয়নালকে গ্রেপ্তার করা হয়। ওই ঘটনায় কোতোয়ালি থানায় ও পরে ডবলমুরিং থানায় নির্বাচন কমিশন মামলা করে। ডবলমুরিংয়ের মামলাটি সিআইডি আর অন্যটি পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট তদন্ত করছে। এ ছাড়া অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে জয়নাল ও তাঁর স্ত্রীর বিরুদ্ধে ওই বছরের ১ ডিসেম্বর মামলাটি করে দুদক।
জয়নাল আবেদীনের বাড়ি জেলার বাঁশখালীর দক্ষিণ জলদীর আশকরিয়াপাড়ায়। তাঁর বাবা মাছ ধরার ট্রলারে শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন। ২০০৪ সালের নভেম্বরে চট্টগ্রাম জেলা নির্বাচন কার্যালয়ে অফিস সহায়ক পদে যোগ দেন জয়নাল।

স্থানীয় সূত্র জানায়, এলাকায় জয়নাল ও তাঁর স্ত্রীর নামে আরও ১৩ শতক জায়গা রয়েছে। যার মূল্য প্রায় ১৭ লাখ ৪০ হাজার টাকা।

দুদকের অভিযোগপত্রে বলা হয়, ৫ হাজার ৯৬০ টাকা বেতন স্কেলে চাকরিতে ঢোকেন জয়নাল। গ্রেপ্তারের আগপর্যন্ত তিনি ১৩ হাজার ৯০০ টাকা বেতন পেতেন। চাকরি থেকে জয়নাল পান ২২ লাখ ৪৬ হাজার ৯০০ টাকা। সাংসারিক ব্যয় ১৭ লাখ ৯৭ হাজার ৫২০ টাকা বাদ দিলে তাঁর কাছে থাকার কথা ৪ লাখ ৪৯ হাজার ৩৮০ টাকা। কিন্তু বাস্তবে জয়নাল ও তাঁর স্ত্রীর নামে পাওয়া গেছে ৭৬ লাখ ৩০ হাজার ৭৬৩ টাকার সম্পদ। এর মধ্যে রয়েছে বাঁশখালীর আশকরিয়া এলাকায় জয়নাল ও তাঁর স্ত্রীর নামে কেনা ৭ শতক জমির ওপর পাঁচতলা ভবন, যা নির্মাণে ৬১ লাখ ২৬ হাজার ৮৪১ টাকা খরচ হয়।

নগরের পাঁচটি ব্যাংক হিসাবে স্বামী–স্ত্রীর নামে ২ লাখ ৩৩ হাজার ৩৪৮ টাকা থাকার তথ্য পায় দুদক।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা দুদক চট্টগ্রামের সহকারী পরিচালক রতন কুমার দাশ প্রথম আলোকে বলেন, শুরু থেকে পলাতক রয়েছেন জয়নালের স্ত্রী আনিছুর নাহার। তাঁকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।

দুদক সূত্র জানায়, একজন রোহিঙ্গাকে এনআইডি দিয়ে জনপ্রতি পাঁচ হাজার টাকা পেতেন জয়নাল। তিনি নিজেই ১ হাজার ৮৪০ রোহিঙ্গাকে এনআইডি করিয়ে দেওয়ার কথা আদালতে জবানবন্দিতে জানিয়েছেন।

অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগের বিষয়ে জয়নালের বক্তব্য জানতে তাঁর মুঠোফোনে কল করা হলে সংযোগ পাওয়া যায়নি। পরে তাঁর আইনজীবী আজিজুর রশিদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ষড়যন্ত্রের শিকার জয়নাল। পাঁচতলা বাড়ি, জমিসহ পৌনে এক কোটি টাকার সম্পদের আয়ের উৎস কী—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এ বিষয়ে আদালতে বলবেন।

জয়নালের একার পক্ষে এমন দুর্নীতি করা সম্ভব নয় বলে মন্তব্য করেন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রামের সম্পাদক আখতার কবির চৌধুরী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, পিয়ন হয়ে জয়নালরা যাঁদের সহযোগিতায় অবৈধ টাকার মালিক হয়েছেন, তাঁদেরও আইনের আওতায় আনা হোক। নইলে এনআইডি নিরাপত্তা হুমকিতে পড়বে।