শিকলমুক্ত মৌসুমী ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠছে

কিছুদিন আগেও ঘরের বারান্দায় এভাবেই শিকলে বাঁধা অবস্থায় থাকত মৌসুমী। গাজীপুরের শ্রীপুরের গাজীপুর পূর্বপাড়ায়
ফাইল ছবি

তিন বছর ঘরের বারান্দায় শিকলবন্দী কেটেছে যে মৌসুমীর (১৩), সে এখন মুক্ত। এই মুক্তির আলোয় বদলে যাওয়া এক নতুন মৌসুমীকেও দেখছে তার পরিবার। কিশোরী মেয়েটি ক্রমে সুস্থ হয়ে উঠতে শুরু করেছে। বাবা আবদুল খালেকেরও যেন দুঃখ কাটতে শুরু করেছে। তাঁর এই খুশি আরও বেড়েছে, সংসার ছেড়ে চলে যাওয়া মেয়ের মা–ও আবার ফিরে এসেছেন।

অভাব-অনটনের সংসারে মা–বাবার ঝগড়া এবং চার বছর আগে বাড়ি ছেড়ে মায়ের চলে যাওয়ায় মৌসুমী কষ্ট পায়, এতে সে মানসিক ভারসাম্য হারায়। তাকে শিকলে বেঁধে রাখতে শুরু করে পরিবার। তিন বছর ধরে কয়েক দফা সংসার ছেড়ে যাওয়া আবদুল খালেকের স্ত্রী নার্গিস আক্তারকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেছেন স্থানীয় লোকজন। কিন্তু তিনি অভিমানে তখন ফিরে আসেননি। তবে প্রায় মৌসুমীর চিকিৎসায় টাকাপয়সা দিতেন, দেখেও যেতেন।

আরও পড়ুন

আবদুল খালেকের বাড়ি গাজীপুরের শ্রীপুরের গাজীপুর পূর্বপাড়া গ্রামে। মৌসুমী আক্তার তাঁর ছোট মেয়ে। মৌসুমীর দাদি খোদেজা বেগমের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আজ থেকে চার বছর আগে এক দিন হঠাৎ মৌসুমীর মা নার্গিস বড় মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে সংসার ছেড়ে বাবার বাড়ি চলে যান। তখন মৌসুমীর বয়স ৯ বছর, স্থানীয় স্কুলের চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ত। কিছুদিন পর অসংলগ্ন আচরণ করছিল সে। কবিরাজ দেখানো হয়। তবে কোনো লাভ হয়নি। দু-এক দিনের মধ্যে ঘরের জিনিসপত্র ভাঙচুর করা শুরু করে সে। একপর্যায়ে পরিবারের লোকজন তার পায়ে শিকল দিয়ে বারান্দার খুঁটির সঙ্গে বেঁধে রাখেন। তখন থেকেই শুরু হয় মৌসুমীর শিকলবন্দী জীবন।

মৌসুমীকে প্রতিবেলার খাবার খাইয়ে দিতে হতো বাবা আব্দুল খালেককে। গাজীপুরের শ্রীপুরের গাজীপুর পূর্বপাড়ায়
ফাইল ছবি– প্রথম আলো

কিশোরী মৌসুমীর দুর্দশা নিয়ে স্থানীয় স্কুলশিক্ষক চঞ্চল খান সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে প্রথম পোস্ট করেন। সেখান থেকে বিষয়টি অনেকের নজরে আসে। গত ৫ আগস্ট ‘যেভাবে শিকলবন্দী হলো মৌসুমীর জীবন’ শিরোনামে প্রথম আলো অনলাইনেও মৌসুমীকে নিয়ে খবর প্রকাশ হয়। এরপর গাজীপুর-৩ আসনের সাংসদ ইকবাল হোসেন মেয়েটির সহযোগিতায় এগিয়ে আসেন।

চিকিৎসার পুরো দায়িত্ব নেওয়ার পর সাংসদ মৌসুমীকে পাঠিয়েছিলেন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ও শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজের সহকারী অধ্যাপক মো. জোবায়ের মিয়ার কাছে। তিনি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জানিয়েছিলেন, মৌসুমী সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত। দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসায় এসব রোগী সুস্থ হয়। তিনি এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেছিলেন, শিশুরা পারিবারিক কলহে নিজেদের অনেক সময় নিরাপত্তাহীন ভাবে। তারা মানসিক কষ্ট পায়। মৌসুমীর ক্ষেত্রেও এমনটা হয়ে থাকতে পারে। পারিবারিক সমস্যাগুলোর ক্ষেত্রে শিশুদের নিয়ে ভাবা দরকার। তাদের সামনে কখনোই কলহবিবাদ করা উচিত নয়।

মৌসুমীর পাশে দাঁড়িয়েছে হাজার হাজার মানুষ। মৌসুমী সুস্থ হচ্ছে। মৌসুমীর বদলে যাওয়া, ওর মা নার্গিসের সংসার দেখার জন্যই মূলত ওই বাড়িতে যাওয়া। খুব আনন্দ হচ্ছে, আমার একটু উদ্যোগে একটি সংসার আবার প্রাণ ফিরে পেল। মানুষ তো মানুষের জন্যই।
ইকবাল হোসেন, গাজীপুর-৩ আসনের সাংসদ

মৌসুমীর বাবা আবদুল খালেক প্রথম আলোকে বলেন, ‘এমপি সাব আইসা মৌসুমীরে ডাক দিছে। সে ডাকের সাড়া দিয়েছে। হাসছে। আগে সে তার কাছে কাউকেই সহ্য করত না। যাকে কাছে পেত, তাকেই মারত। আমার হাতে ছাড়া অন্য কারও হাতে ভাত খেত না। এখন দুই মাস ধরে চিকিৎসা চলার পর অনেকটাই ভালোর দিকে।’ মৌসুমীর শিকলে বাঁধা জীবন থেকে মুক্ত করতে পেরে তাঁদের পরিবারের সবাই খুশি।

সাংসদের ব্যবস্থাপনায় চিকিৎসা শুরুর পর মৌসুমীর মা স্বামীর সংসারে আবার ফিরে এসেছেন। সাংসদ নিজে উদ্যোগ নিয়ে, কথা বলে তাঁকে স্বামীর সংসারে ফিরে আসতে উৎসাহ দিয়েছেন। গতকাল মঙ্গলবার মৌসুমীর খোঁজ নিতে তার বাড়িতে যান সাংসদ ইকবাল হোসেন। মৌসুমীর জন্য নতুন জামা, ফলমূল ও পরিবারের অন্য সদস্যদের জন্য উপহার নিয়ে যান তিনি। প্রথম আলোকে সাংসদ বলেন, ‘মৌসুমীর পাশে দাঁড়িয়েছে হাজার হাজার মানুষ। ইতিমধ্যে তার মা তার কাছে ফিরে এসেছেন। মৌসুমী সুস্থ হচ্ছে। মৌসুমীর বদলে যাওয়া, ওর মা নার্গিসের সংসার দেখার জন্যই মূলত ওই বাড়িতে যাওয়া। খুব আনন্দ হচ্ছে, আমার একটু উদ্যোগে একটি সংসার আবার প্রাণ ফিরে পেল। মানুষ তো মানুষের জন্যই।’