টাঙ্গাইলের মির্জাপুর উপজেলার বাঁশতৈল ইউনিয়নের পাঁচগাঁও গ্রামের মো. দেলোয়ার হোসেন। ২০১৫ সালে ১০০ পেয়ারাগাছের চারা দিয়ে ফলের বাগান শুরু করেন তিনি। ২০১৮ সালের অক্টোবরে বাগানে প্রথম ৮৫টি মাল্টাগাছ লাগান। বর্তমানে তাঁর বাগানে ১ হাজার ১০০টি গাছে মাল্টা ধরেছে।

চলতি মৌসুমে শুধু মাল্টাই ছয় লাখ টাকায় বিক্রি করার আশা করছেন তরুণ কৃষি উদ্যোক্তা দেলোয়ার হোসেন। তিনি বলেন, ছয় লাখ টাকায় মাল্টা বিক্রি হলে সব খরচ বাদে লাভ থাকবে অন্তত চার লাখ টাকা। এ ছাড়া বাগানের অন্যান্য ফল বিক্রি করেও বেশ মুনাফা হবে। আগামী বছর উৎপাদন খরচ কমে যাবে, তখন আরও বেশি লাভ হওয়ার সম্ভাবনা আছে।

দেলোয়ার পর্যায়ক্রমে বাগানের জমির আয়তন ও বিভিন্ন ধরনের ফলগাছের সংখ্যা বাড়াতে থাকেন। বর্তমানে ৫৬০ শতাংশ জমিতে ৪ হাজার পেয়ারা, ১১০০ মাল্টা, ৬০০ লেবু, ৩০০ কলা, ৩৫০ পেঁপে, ২৬০ আম, দার্জিলিংয়ের কমলা ৮৫, চায়না কমলা ৬৪, আমড়া ৪০, লটকন ৩০, কতবেল ২৫, জাম্বুরা ২০, ডালিম ৮, চেরি ফল ৬ ও রামবুটানগাছ ৪টি। এসব গাছে বেশ ফলও ধরেছে। এরই মধ্যে তিনি পেয়ারা, আমড়া, বারোমাসি আম ও পেঁপে বিক্রি শুরু করেছেন।

শুক্রবার পাঁচগাঁও গ্রামে সরেজমিনে দেখা যায়, বাগানের প্রতিটি গাছেই মাল্টা ঝুলছে। সবুজ রঙের মাল্টাগুলো ১২০ থেকে ১৪০ টাকা কেজি দরে কিনে নিচ্ছেন ক্রেতা ও খুচরা ব্যবসায়ীরা। এ ছাড়া আকার ভেদে ৪০-৭০ টাকা কেজি দরে পেঁপে, ৪০-৫০ টাকা পেয়ারা এবং ৩০-৪০ টাকা কেজিতে আমড়া বিক্রি হচ্ছে।

বাগানে মাল্টা নিতে আসা শফিকুল ইসলাম বলেন, আগে এই বাগান থেকে তিনি পেয়ারা কিনেছেন। এখন মাল্টা নিচ্ছেন। সবুজ মাল্টাগুলো খেতে ভারি মিষ্টি ও সুস্বাদু।
পেয়ারা চাষে দেলোয়ার হোসেন ব্যাগিং পদ্ধতি ব্যবহার করছেন। তবে মাল্টা চাষে ব্যাগিং পদ্ধতির দরকার হয় না বলে জানালেন তিনি। জৈব সার, রাসায়নিক সার, দানাদার বিষ ও কীটনাশকের মাধ্যমে ঠিকমতো যত্ন নিলেই মাল্টার ফলন হয়। তিনি নাটোর থেকে মাল্টার চারা সংগ্রহ করেছেন। নাটোর ছাড়াও অন্য সব গাছের চারা এনেছেন দিনাজপুর ও ঝিনাইদহ থেকে। তিনি ৭৫ থেকে ২৫০ টাকা দরে প্রতিটি মাল্টার চারা কিনেছেন। তাঁর বাগানে বর্তমানে নিয়মিত চারজন শ্রমিক কাজ করছেন। অনিয়মিত আরও বেশ কয়েকজন শ্রমিককে কাজে লাগান। দেলোয়ারের উদ্যোগ দেখে স্থানীয় কৃষি বিভাগও তাঁকে সহায়তা করছে।

দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘পেয়ারা দিয়ে বাগান শুরু করলেও পরে মাল্টার প্রতি আগ্রহ তৈরি হয়। আমি মাটির গুণাগুণ নিয়ে টেনশনে ছিলাম। তবে আমাদের এই মাটি যথেষ্ট উপযুক্ত। ফল খুবই মিষ্টি। বাজারে বর্তমানে বারি–১ জাতের মাল্টা বিক্রি করছি। সবুজ মাল্টা মিষ্টি হবে কি না, তা নিয়ে মানুষের সংশয় আছে। তবে লোকজন এসে মাল্টা খেয়ে কিনে নিচ্ছেন।’ আগাছা পরিষ্কার ও রক্ষণাবেক্ষণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে বাগানের খরচ কমে আসে। পানি দিতে তিনি পাইপ ব্যবহার করেন। যন্ত্রের সাহায্যে তিনি নিড়ানির কাজ করছেন।

যে জায়গায় দেলোয়ার বাগান করেছেন, সেখানে আগে গরু-ছাগল চরানো হতো বলে জানালেন স্থানীয় বাসিন্দা হাজি ফারুক হোসেন। তিনি বলেন, এখন দূরের লোকজন এসে ফল কিনছেন। এতে দেলোয়ারও স্বাবলম্বী হয়েছেন, অন্য লোকও বাগানে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। সেই সঙ্গে বিষমুক্ত ফল পেয়ে উপকৃত হচ্ছেন সাধারণ ক্রেতারা।

নিজের বাগানে তরুণ কৃষি উদ্যোক্তা দেলোয়ার হোসেন। শুক্রবার দুপুরে টাঙ্গাইলের মির্জাপুর উপজেলার বাঁশতৈল ইউনিয়নের পাঁচগাঁও গ্রামে
ছবি: প্রথম আলো

বারি–১ জাতের মাল্টা খুবই রসাল ও মিষ্টি বলে জানান উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোহাম্মদ মশিউর রহমান। তিনি বলেন, অপরিপক্ব অবস্থায় মাল্টা খাওয়া উচিত নয়। কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে দুই একর জমিতে প্রদর্শনীর মাধ্যমে তাঁকে সার, ওষুধ, স্প্রে মেশিনসহ বিভিন্ন সহায়তা দেওয়া হয়েছে।

পাঁচগাঁও গ্রামের গিয়াস উদ্দিনের চার ছেলে ও দুই মেয়ের মধ্যে দেলোয়ার পঞ্চম। দেলোয়ার গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার সফিপুরের আনসার ভিডিপি উচ্চবিদ্যালয় থেকে ২০০২ সালে এসএসসি পাস করেন। ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন ২০০৪ সালে। ২০১১ সালে ঢাকার তিতুমীর কলেজ থেকে স্নাতক (সম্মান) ও ২০১৪ সালে স্নাতকোত্তর পাস করেন। স্নাতক পাসের পর তিনি ঢাকায় বায়িং হাউসে কাজ শুরু করেন। পাশাপাশি গড়ে তোলেন ডেভেলপার প্রতিষ্ঠান। ২০১৫ সালে দুই ব্যবসায় তাঁকে লোকসান গুনতে হয়। পরে গ্রামের বাড়ি ফিরে নিজেদের জমিতে পেয়ারাগাছ লাগিয়ে ফলের বাগান শুরু করেন। তারপর আর তাঁর পেছনে ফিরতে হয়নি। বর্তমানে মাল্টা চাষে পেয়েছেন সাফল্য। স্বপ্ন এখন তাঁর হাতের মুঠোয়। প্রচেষ্টা, পরিশ্রম ও আত্মবিশ্বাস নিয়ে আরও বড় সাফল্যের পেছনে ছুটে চলেছেন তরুণ উদ্যোক্তা দেলোয়ার।