‘সব স্বপ্ন পুড়ে গিয়ে নিভে গেল আজ’
ইংরেজি সাহিত্য স্নাতকোত্তর শেষ করে চাকরির প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন সাবরিনা খালেদ (২৪)। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি পরীক্ষায় অংশও নিয়েছিলেন। ছোট বোন সামিয়া খালেদের (১৮) ব্যস্ততা উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা নিয়ে। এই দুই মেয়েকে নিয়ে স্বপ্ন বুনছিলেন বাবা আলাউদ্দিন খালেদ। কিন্তু সব স্বপ্ন পুড়ে গিয়ে নিভে গেল আজ। গ্যাস বিস্ফোরণে দগ্ধ হয়ে মাত্র এক দিনের ব্যবধানে হারালেন দুই মেয়েকে। সন্তান হারানোর শোকে বাবা–মা এখন পাথর।
গত বৃহস্পতিবার নগরের বাকলিয়া থানার রাহাত্তরপুল এলাকার বিসমিল্লাহ টাওয়ারের একটি বাসায় গ্যাস বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। আগুনে দগ্ধ হয়েছিলেন বাসায় থাকা দুই বোন। তবে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ঘটনাস্থলে পৌঁছার আগেই প্রতিবেশীরা আগুন নিভিয়ে ফেলেন। এরপর দগ্ধ দুই বোনকে প্রথম চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এবং পরে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়। তাঁদের দুজনের শরীরের প্রায় ৫০ শতাংশ পুড়ে গিয়েছিল। ঢাকায় শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রোববার বড় বোনের এবং আজ সোমবার ছোট বোনের মৃত্যু হয়।
এমন করুণ মৃত্যুর জন্য বাড়ির মালিক ও তত্ত্বাবধায়কের গাফিলতি ও অবহেলাকে দায়ী করছেন নিহত তরুণীদের স্বজনেরা। তাঁদের অভিযোগ, সংযোগ লিকেজের কারণে গ্যাস বের হওয়ার বিষয়টি কয়েকবার বাড়ির মালিক ও তত্ত্বাবধায়ককে জানানো হয়েছিল। কিন্তু তাঁরা ব্যবস্থা নেননি।
নিহত সাবরিনা খালেদ (২৪) আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম (আইআইইউসি) থেকে ইংরেজি সাহিত্য স্নাতকোত্তর করেন। ছোট বোন সামিয়া হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজে উচ্চমাধ্যমিকে অধ্যয়নরত ছিল। তাঁদের গ্রামের বাড়ি চন্দনাইশ উপজেলার ফতেহ নগরে। মা শারমিন খালেদকে নিয়ে নগরের বাসায় থাকতেন দুই বোন। বাবা আলাউদ্দিন খালেদ স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য। তবে দুর্ঘটনার দিন মা ও বাবা গ্রামের বাড়িতে ছিলেন।
আমার মেয়েরা পুড়ে শেষ হয়ে গেছে। আমার স্বপ্নও পুড়ে গেছে।
সাবরিনার খালাতো ভাই তাইমুল ইসলাম ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, গ্যাস লিকেজের বিষয়টি আট মাস আগে একবার বাড়ির তত্ত্বাবধায়ককে জানানো হয়। কিন্তু ওই সময় তিনি কোনো গুরুত্ব দেননি। দুর্ঘটনার চার দিন আগেও একবার জানানো হয়। তখনো গ্যাস বের হওয়ার বিষয়টি উড়িয়ে দেন তত্ত্বাবধায়ক। একবার যদি গুরুত্ব দিতেন, তাহলে এই দুর্ঘটনা ঘটত না।
সামিয়াদের আগে ওই বাসায় থাকতেন তাঁদের ফুপাতো বোন পারভীন। তাঁরা প্রায় সাত বছর ওই বাসায় ছিলেন। দুই বছর আগে বাসা ছেড়ে দেন। এরপর সাবরিনারা বাসাটি ভাড়া নেন। পারভীন জানান, বাসা ছেড়ে দিলেও ঘরের কিছু জিনিস রেখে গিয়েছিলেন। গত সপ্তাহে সেগুলো আনার জন্য পুরোনো বাসায় গিয়েছিলেন তিনি। ওই সময় জিনিসপত্র বের করার সময় ঘরে গ্যাসের গন্ধ পান। সঙ্গে সঙ্গে বাড়ির তত্ত্বাবধায়ককে ডেকে এনে তা জানিয়েছিলেন। কিন্তু কোনো গুরুত্ব দেননি তিনি।
দুর্ঘটনার পর ওই ভবনের গ্যাস–সংযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে বলে জানান কর্ণফুলী গ্যাস বিতরণ কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপক তরণী সূত্রধর। তিনি দাবি করেন, ঘটনাস্থলে গিয়ে গ্যাস লিকেজের কোনো কিছু পাননি তাঁরা। হয়তো চুলা খোলা ছিল। সেখান থেকেও গ্যাস বের হতে পারে।
বাড়ির তত্ত্বাবধায়ক মো. ইসমাইল বলেন, ভাড়াটিয়াদের কাছ থেকে গ্যাস লিকেজের বিষয়টি জানার পর তা বাড়ির মালিককে জানিয়েছিলেন। এখানে তাঁর কোনো অবহেলা নেই। বাড়ির মালিক চিকিৎসার জন্য ভারতে অবস্থান করছেন। তাই তাঁর কোনো বক্তব্য জানা যায়নি। তিনি অন্য একটি বাড়িতে পরিবার নিয়ে থাকেন।
এদিকে এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত কোনো মামলা হয়নি। নগরের বাকলিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রাশেদুল হক প্রথম আলোকে বলেন, এ বিষয়ে নিহত দুই বোনের বাবার সঙ্গে সরাসরি কথা বলেছেন। কিন্তু পরিবারের পক্ষ থেকে কোনো অভিযোগ বা মামলা করার বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেনি।
যোগাযোগ করা হলে মুঠোফোনে আলাউদ্দিন খালেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার অনেক বড় ক্ষতি হয়ে গেছে। আমার মেয়েরা পুড়ে শেষ হয়ে গেছে। আমার স্বপ্নও পুড়ে গেছে। মামলা করে কী হবে? এখন তো আর মেয়েদের ফিরে পাব না।’