জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা ইউনেসকোর ‘অ্যাওয়ার্ড অব মেরিট’ পুরস্কার জিতল ঢাকার কেরানীগঞ্জের দোলেশ্বর হানাফিয়া জামে মসজিদ। এর মধ্য দিয়ে প্রায় ১৫০ বছরের বেশি সময় ধরে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মসজিদটি এই সংস্থার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অসামান্য স্বীকৃতি পেল।

গত বুধবার ‘ইউনেসকো এশিয়া-প্যাসিফিক অ্যাওয়ার্ডস ফর কালচারাল হেরিটেজ কনজারভেশন’ নামের ওই পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। ছয়টি দেশের নয়টি স্থাপনা পাঁচটি ক্যাটাগরিতে ইউনেসকোর এই পুরস্কার পেয়েছে। ‘অ্যাওয়ার্ড অব মেরিট’ এই পাঁচ ক্যাটাগরির একটি। এই শ্রেণিতে বাংলাদেশের ওই মসজিদ ছাড়াও মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডের দুটি স্থাপনা পুরস্কার জেতে। অপর চার ক্যাটাগরি হলো, ‘অ্যাওয়ার্ড অব এক্সিলেন্স’ (ভারত), অ্যাওয়ার্ড অব ডিস্টিংশন (চীন ও জাপান), নিউ ডিজাইন ইন হেরিটেজ কনটেক্সটস (চীন) ও স্পেশাল রিকগনিশন ফর সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট (চীন, জাপান, ভারত ও থাইল্যান্ড)।

দোলেশ্বর হানাফিয়া জামে মসজিদ কেরানীগঞ্জ উপজেলার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানাধীন কোন্ডা ইউনিয়নের দোলেশ্বর গ্রামে অবস্থিত। দেড় শ বছরের পুরোনো মসজিদটির পুরোনো আদল ধরে রেখে ও নবাব আমলের ঐতিহ্য বজায় রেখে নিপুণ হাতে সংস্কারকাজ করেছেন স্থপতি সাঈদ মোস্তাক আহমেদ।

দেশের বিভিন্ন স্থান, এমনকি বিদেশ থেকেও পর্যটকেরা এ মসজিদ দেখতে আসেন। বাংলাদেশের আধুনিক স্থাপনার তালিকায় মসজিদটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করে আছে। বাংলাদেশের অনন্য এই স্থাপনা নিয়ে নিউইয়র্ক টাইমসসহ কয়েকটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে একাধিকবার ফিচার হয়েছে।

অনুসন্ধান করে জানা গেছে, স্থাপত্য সৌন্দর্যমণ্ডিত দৃষ্টিনন্দন মসজিদটি দারোগা আমিনউদ্দিন আহাম্মদ বাংলা ১২৭৫ সনে (ইংরেজি ১৮৬৮ ও হিজরি ১২৮৫ সন) নিজ উদ্যোগে প্রথম নির্মাণকাজ শুরু করেন। জনশ্রুতি আছে, মসজিদটি নির্মাণের প্রথম উদ্যোক্তা দারোগা আমিনউদ্দিন হওয়ায় এটি ‘দারোগা মসজিদ’ নামেই বেশি পরিচিত ছিল। তাঁর ছেলে মইজউদ্দিন আহাম্মদ ছিলেন এটির প্রথম মোতোয়ালি। মইজদ্দিন আহাম্মদ, তমিজউদ্দিন আহাম্মদ, করিমউদ্দিন আহাম্মদ, খিদির বক্স মিয়া ও আবদুল গফুর আহাম্মদ মসজিদটির জন্য জমি ওয়াক্ফ করেন।

ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, দুই সহোদর খিদির বক্স ও কাদের বক্স এবং মইজউদ্দিন আহাম্মদ পরিবার বংশানুক্রমে মসজিদটির নির্মাণ ও সংস্কারকাজে জড়িত ছিল। কাদের বক্সের দৌহিত্র ও আলহাজ হাফেজ মো. মুছার ছেলে তৎকালীন সংসদ সদস্য হামিদুর রহমান মিনারসহ মসজিদটির বর্ধিত অংশ ১৯৬৮ সালে নির্মাণ করেন। এরপর মসজিদটি একাধিকবার সম্প্রসারণ করা হয়। কালের আবর্তে এটির অবকাঠামো জরাজীর্ণ হয়ে বিলীন হয়ে পড়ছিল। তখন মসজিদটিকে সংস্কার করে পুরোনো রূপ দেওয়ার উদ্যোগ নেন স্থানীয় সংসদ সদস্য ও বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। স্থপতি আবু সাঈদ এম আহমেদের তত্ত্বাবধানে মসজিদটির অবকাঠামো ঠিক রেখে পুনঃসংস্কারের কাজ শুরু করা হয়। ২০১৮ সালে সংস্কার শেষ হয়। পুরোনো মসজিদের পাশেই নির্মাণ করা হয় নতুন আরেকটি মসজিদ। পুরোনো মসজিদটি এখন গ্রন্থাগার ও মক্তবে রূপান্তর করা হয়েছে।

ঢাকা-৩ আসনের সাংসদ ও বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, ‘এই মসজিদ প্রতিষ্ঠিত হয় আমাদের পূর্বপুরুষদের হাত ধরে। চার প্রজন্ম ধরে আমরা এটি রক্ষণাবেক্ষণ করে আসছি। নতুন করে যখন মসজিদটি নির্মাণ করা হয়, তখন পুরোনো মসজিদের আদল ধরে রেখে সংস্কার করাই ছিল আমাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।’ তিনি বলেন, ‘ইউনেসকোর পুরস্কার পেয়েছে মসজিদটি। এটি দেশের জন্য যেমন বিরাট সম্মানের, তেমনি আমার জন্যও দারুণ আনন্দের।’