সাকিমা–সাবিদ এখন কোথায় যাবে?

বাবা-মাকে হারিয়ে অসহায় সাকিমা ও সাবিদ। যাকেই দেখছে, ছলছল চোখে তাকিয়ে থাকছে। কিছু বলছে নাছবি: প্রথম আলো

মা থেকেও নেই। মাসখানেক আগে তিনি সংসার ছেড়ে চলে গেছেন। মা চলে যাওয়ার পর সাকিমা আক্তার মারিয়া (৯) আর সাবিদ হাসানের (৬) বাবাই তাদের আগলে রাখছিলেন। সেই বাবাও এবার তাদের ছেড়ে চলে গেলেন। বাবার প্রস্থান সাময়িক কোনো বিরতি নয়। একেবারেই না–ফেরার দেশে গিয়েছেন তিনি। মা অন্যত্র চলে যাওয়ায় ও বাবা মারা যাওয়ায় সাকিমা-সাবিদের গন্তব্য তাই এবাড়ি–ওবাড়ি। যাকেই দেখছে, ছলছল চোখে তাকিয়ে থাকছে। কিছু বলছে না।

প্রতিবেশীরা বলছেন, কত দিন এভাবে চলবে শিশু দুটির। তাঁরাই–বা কত দিন ওদের দেখেশুনে রাখবেন। দরিদ্র বাবা তাদের জন্য কোনো সম্পদও রেখে যেতে পারেননি। শুধু রেখে গেছেন কিছু স্মৃতি, কিছু মায়া আর এনজিওর ২০ হাজার টাকার ঋণের বোঝা।

সাকিমা-সাবিদের বাড়ি ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার ত্রিলোচনপুর ইউনিয়নের বড় ঘিঘাটি গ্রামে। তাদের বাবা আবদুল মজিদ একজন কৃষক ছিলেন। সম্প্রতি বাড়ির পাশে কালীগঞ্জ-জীবননগর সড়কের লাউতলা এলাকায় একটি পরিবহনের টিকিট বিক্রির জন্য কাউন্টার খোলেন তিনি।

আবদুল মজিদের বড় ভাই আজিজুল ইসলাম প্রথম আলোকে জানান, ছোট ভাই মজিদের দিন কাটত খুবই কষ্টে। দুই সন্তান আর স্ত্রীকে নিয়ে চলছিল সংসার। মাত্র ১০ শতক চাষের জমি ছিল তাঁর। কাউন্টার থেকে দিনে ২০০-৩০০ টাকা আয় করতে পারতেন। কখনো কখনো সেটিও হতো না। তবু সংসার চলে যাচ্ছিল। টিনের চালার একটি ঘরে বাস করতেন তাঁরা। মেয়ে সাকিমা তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ছে আর ছেলে সাবিদ সবে স্কুলে যেতে শুরু করেছিল।

আজিজুল ইসলাম বলেন, গত ১৪ ফেব্রুয়ারি ভোরে মজিদের স্ত্রী সবাইকে রেখে বাড়ি থেকে চলে যান। পরে তিনি খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, তিনি অন্য এক যুবককে বিয়ে করেছেন। স্ত্রী যাওয়ার পর দুই সন্তানকে নিয়ে মজিদ একরকম পথে পথেই ঘুরতেন। দুশ্চিন্তায় দিন পার হতো তাঁর। ১৮ মার্চ সকালে ঘরে একা শুয়ে ছিলেন মজিদ। দুই সন্তান বাইরে খেলা করছিল। এ সময় বুকের ব্যথা উঠে ঘরের মধ্যে পড়ে থাকেন মজিদ। প্রতিবেশী একজন এসে তাঁকে এভাবে দেখে চিৎকার দিলে অন্যরাও এগিয়ে আসেন। তাঁরা মজিদকে নিয়ে যান কালীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। সেখান থেকে চিকিৎসকেরা তাঁকে যশোর সদর হাসপাতালে নেওয়ার পরামর্শ দেন। ওই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২০ মার্চ সকালে তিনি মারা যান।

আবদুল মজিদের ভাই আজিজুল আরও বলেন, মজিদ সারাক্ষণ চিন্তিত থাকায় তাঁর স্ট্রোক হয়েছে বলে চিকিৎসকেরা ধারণা করেছেন। তাঁর মৃত্যুর পর সবচেয়ে বেশি অসহায় অবস্থায় আছে বাচ্চা দুটি। তাদের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। তারাও কারও সঙ্গে ঠিকমতো কথা বলছে না, শুধু অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকছে।

শিশু দুটির চাচি লিপি খাতুন বলেন, বাবার মৃত্যুর পর দুই দিন ধরে সাকিমা-সাবিদের দেখাশোনা তিনি করছেন। শিশু দুটির নিজের বলে আর কিছু থাকল না। বাবার রেখে যাওয়া টিনের চালায় তারা একা থাকতে পারছে না।

ভাই আজিজুল ইসলাম জানান, শিশু দুটির বাবা তাদের জন্য কোনো অর্থই রেখে যেতে পারেননি। উল্টো পরিবহনের কাউন্টার নির্মাণ করতে একটি এনজিও থেকে ২০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিলেন তিনি। সেই ঋণ এই শিশুদের পক্ষে শোধ করাও সম্ভব নয়।

কালীগঞ্জ উপজেলার ত্রিলোচনপুর ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য রবজেল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে তাঁরা চেষ্টা করবেন শিশু দুটিকে সহযোগিতা করার। তবে শিশু দুটি খুবই অসহায়। তাদের দেখার কেউ থাকল না। তারা কীভাবে বেড়ে উঠবে, সেটাই চিন্তার বিষয়।