সিলেট বিভাগের চার জেলায় সারের পর্যাপ্ত মজুত আছে বলে জানিয়েছে কৃষি অধিদপ্তর। তবে গ্রামগঞ্জের হাটবাজারে সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে সার বস্তাপ্রতি ৫০ টাকা ও কেজিপ্রতি চার টাকা বেশিতে কেনাবেচার অভিযোগ করেছেন কৃষকেরা। ডিলার থেকে শুরু করে খুচরা বিক্রেতাদের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ করেছেন তাঁরা।
কৃষি অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বিভাগে সারের কোনো সংকট নেই। তাই যাঁদের বিরুদ্ধে বাড়তি দামে সার বিক্রির অভিযোগ পাওয়া যাবে, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর উপজেলায় খুচরা বিক্রেতাদের পাশাপাশি ডিলারদের বিরুদ্ধেও বেশি দামে সার বিক্রির অভিযোগ পাওয়া গেছে। উপজেলার ৯ জন ডিলারের মাধ্যমে কৃষকদের মধ্যে ন্যায্যদামে সার বিক্রির কথা থাকলেও কৃষকদের অতিরিক্ত দামে সার কিনতে হচ্ছে।
সারের দাম বেশি রাখার বিষয়ে জগন্নাথপুর উপজেলার রানীগঞ্জ ইউনিয়নের নারিকেলতলা গ্রামের কৃষক রূপ মিয়া বলেন, রানীগঞ্জ বাজারে ডিলার ধনেশ রায়ের দোকান থেকে ইউরিয়া সার কেজিপ্রতি ১৬ টাকার পরিবর্তে ২০ টাকা দরে কিনতে হচ্ছে। জগন্নাথপুর পৌরসভার ভবানীপুর এলাকার কৃষক সমসুল হক বলেন, তিনিও ইউরিয়া সার কেজিপ্রতি ২০ টাকা দরে এক ডিলারের দোকান থেকে কিনেছেন।
এ বিষয়ে রানীগঞ্জ বাজারে সারের ডিলার ধনেশ রায় অভিযোগের বিষয়ে বলেন, তাঁরা ইউরিয়া সার কেজিপ্রতি ১৬ টাকা দরেই বিক্রি করছেন। ব্যাগের জন্য কেবল অতিরিক্ত ২ টাকা বাড়তি নিচ্ছেন। ২০ টাকা দরে সার বিক্রি করার অভিযোগ সঠিক নয়।
জগন্নাথপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শওকত ওসমান মজুমদার বলেন, প্রত্যেক ডিলারের দোকানে সারের মূল্যতালিকা টাঙানো আছে। অতিরিক্ত দামে বিক্রির অভিযোগ পেলে ডিলারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জগন্নাথপুর উপজেলার হাওর বাঁচাও আন্দোলনের যুগ্ম আহ্বায়ক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা নির্মল দাশ প্রথম আলোকে বলেন, অধিকাংশ ডিলার সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দামে সব ধরনের সার বিক্রি করছেন। অনেক সময় তাঁরা কৃত্রিম সংকট দেখিয়ে অতিরিক্ত দামে সার বিক্রি করছেন। এঁদের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্টদের কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
সুনামগঞ্জের ধরমপাশা উপজেলার বংশীকুণ্ডা বাজারে খুচরা সার বিক্রেতা মো. বাবুল মিয়ার বিরুদ্ধে স্থানীয় একাধিক কৃষক বস্তাপ্রতি ৫০ টাকা অতিরিক্ত দামে সার বিক্রির অভিযোগ করেছেন। তবে বাবুল মিয়া দাবি করেছেন, তাঁর এলাকাটি দুর্গম হওয়ায় যাতায়াত ব্যবস্থা ভালো নয়। এতে পরিবহন খরচ বেশি পড়ায় কিছুটা বেশি দামে তাঁকে সার বিক্রি করতে হচ্ছে। বিষয়টি বুঝতে পেরে কৃষকেরাও কোনো রকম আপত্তি করছেন না।
একাধিক কৃষক জানিয়েছেন, সিলেটে এখন বোরো আবাদের মৌসুম চলছে। বিভাগের অধিকাংশ এলাকা হাওর অধ্যুষিত হওয়ায় এখানে প্রতিবছরই পলি জমে। জমির উর্বরতা শক্তি তুলনামূলকভাবে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে ভালো। এই অঞ্চলে সারের মোটামুটি চাহিদা থাকে। মৌসুমের শুরু হওয়ায় এখনো সারের প্রয়োজন খুব একটা দেখা দেয়নি। আরও ১৫ থেকে ২০ দিন পর সারের চাহিদা দেখা দেবে। তখন কিছু অসাধু ব্যবসায়ী বাড়তি দামে সার বিক্রির পাঁয়তারা করতে পারে। তবে আগে থেকেই স্থানীয় প্রশাসন তৎপর থাকলে এসব বিক্রেতারা সারের দাম কোনোভাবেই বাড়াতে পারবে না।
সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও সুনামগঞ্জের একাধিক কৃষক জানিয়েছেন, এখনো সারের বাজারে দাম নিয়ন্ত্রণে আছে। কিছু ডিলার ও খুচরা বিক্রেতা ছাড়া বাড়তি দামে সার বিক্রির অভিযোগ খুব একটা নেই। তবে সুনামগঞ্জের কিছু হাটবাজারে বাড়তি দামে সার বিক্রির অভিযোগ আছে। সারের পূর্ণ চাহিদা শুরুর আগেই বাড়তি দামে সার বিক্রির বিষয়টি দুঃখজনক ও অপ্রত্যাশিত। সংশ্লিষ্টদের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখা উচিত।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সিলেট অঞ্চলের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, সরকার প্রতি বস্তা (৫০ কেজির বস্তা) ইউরিয়া সারের খুচরা মূল্য ৮০০ টাকা (১৬ টাকা প্রতি কেজি), টিএসপি (ট্রিপল সুপার ফসফেট) প্রতি বস্তা ১ হাজার ১০০ টাকা (২২ টাকা প্রতি কেজি), এমওপি (মিউরেট অব পটাশ) প্রতি বস্তা ৭৫০ টাকা (১৫ টাকা প্রতি কেজি), ডিএপি (ড্রাই-অ্যামোনিয়াম ফসফেট) প্রতি বস্তা ৮০০ টাকা (১৬ টাকা প্রতি কেজি) নির্ধারণ করে দিয়েছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সিলেট অঞ্চল আরও জানায়, চলতি ডিসেম্বর মাসে সিলেট বিভাগের চার জেলায় ১৬ হাজার ৫৩ মেট্রিক টন ইউরিয়া, ৬ হাজার ৬৯ মেট্রিক টন টিএসপি, ৫ হাজার ৯১৪ মেট্রিক টন এমওপি ও ১৩ হাজার ৭৬৯ মেট্রিক টন ডিএপি সার বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। বিভাগের ৩২৯ জন ডিলারের মাধ্যমে এসব সার বিতরণ করা হয়।
৩০ ডিসেম্বরের তথ্য অনুযায়ী, চার জেলার কৃষক পর্যায়ে ৮ হাজার ২৭১ মেট্রিক টন ইউরিয়া, ২ হাজার ৯৫৪ মেট্রিক টন টিএসপি, ৩ হাজার ৯৪৪ মেট্রিক টন এমওপি এবং ৭ হাজার ৯৬২ মেট্রিক টন ডিএপি বিতরণ করা হয়েছে।
ধরমপাশা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. নাজমুল ইসলাম বলেন, নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দামে সার বিক্রি করা সম্পূর্ণভাবে বেআইনি। তবে এ-সংক্রান্ত কোনো অভিযোগ তাঁরা এখনো পাননি। কোনো ডিলার অথবা খুচরা সার বিক্রেতার বিরুদ্ধে অতিরিক্ত দামে সার বিক্রি করার সত্যতা পাওয়া গেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সিলেট অঞ্চলের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ১৫ অক্টোবর থেকে বোরো মৌসুমের আবাদ শুরু হয়েছে। চলতি বোরো মৌসুমে সিলেট বিভাগের চার জেলার ৪ লাখ ৮৫ হাজার ৪৯৫ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। এর বিপরীতে আজ বৃহস্পতিবার ১ লাখ ১৬ হাজার ৮০৭ হেক্টর জমিতে বোরো রোপণ করা হয়েছে। যা লক্ষ্যমাত্রার ২৪ শতাংশ।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সিলেট অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক দিলীপ কুমার অধিকারী প্রথম আলোকে বলেন, সিলেটে পর্যাপ্ত পরিমাণে সার বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। তাই সারের সংকট হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এ ছাড়া বাড়তি দামে সার বিক্রির কোনো অভিযোগও আসেনি। বাড়তি দামে সার বিক্রির অপতৎপরতা চালালে তাৎক্ষণিকভাবে ওই ডিলারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। স্থানীয় প্রশাসন ও মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা কড়া নজরদারি রাখছেন।
*** এই প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন সুনামগঞ্জের ধরমপাশা প্রতিনিধি সালেহ আহমদ ও জগন্নাথপুর প্রতিনিধি অমিত দেব।