সেই আলী আনছারের পরিবারে এবারও ঈদ নেই
আবদুল আলী আনছার (১৮) ঢাকার একটি কারখানায় শ্রমিকের কাজ করতেন। তাঁর আয়ে চলত সংসার। ঈদসহ বিভিন্ন উৎসবে ছোট ভাইবোনদের নতুন কাপড় কিনে দিতেন। গত বছর ঈদে বাড়ি আসতে গিয়ে ফেরিতে যাত্রীদের চাপে মৃত্যু হয় আনছারের। তখন ঈদের উৎসব বিষাদে পরিণত হয় পরিবারটির জন্য। এক বছর হলো আনছার নেই। তাই এ বছরও আনন্দের ঈদ পরিবারটির কাছে বিষাদ হয়ে এসেছে।
শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার কালিকা প্রসাদ গ্রামের নির্মাণশ্রমিক গিয়াস উদ্দিন ও নাছিমা বেগম দম্পতির ছেলে আবদুল আলী আনছার। দারিদ্র্যের কারণে পড়ালেখা করা হয়নি। অভাবের সংসারের হাল ধরতে শিশু বয়সেই ঢাকার মীর হাজিরবাগে একটি পর্দা প্রস্তুতের কারখানায় কাজ শুরু করেন। গত বছর ১২ মে ঈদের ছুটিতে গ্রামে আসার পথে ফেরিতে যাত্রীদের চাপে মারা যান। শিমুলিয়া-বাংলাবাজার নৌপথে এ দুর্ঘটনায় আলী আনছারের সঙ্গে আরও চার যাত্রী প্রাণ হারান।
আলী আনছারদের বাড়ি নড়িয়ার মোক্তারেরচর ইউনিয়নের কীর্তিনাশা নদীর তীরে। ২০ বছর আগে নদীতে তাঁদের বসতঘর বিলীন হয়ে যায়। তখন কালিকা প্রসাদ গ্রামে একটি সরকারি জমিতে ঝুপরিতে আশ্রয় নেয় আলী আনছারের পরিবার। সেই ঝুপরিতেই কেটে যায় ১৯-২০ বছর। আনছারের মা নাছিমা বেগম পুরান ঢাকায় একটি ব্যাটারির কারখানায় কাজ করতেন। বছর তিনেক আগে দুর্ঘটনায় হাতে চোট পান, একটি আঙুল কেটে ফেলতে হয়। অর্থাভাবে চিকিৎসা করাতে না পেরে এখন তাঁর একটি হাত ও পায়ের কিছু অংশ কাজ করে না, অবস হয়ে গেছে।
আলী আনছারের আয়ে সংসার চলছিল না। এমন পরিস্থিতিতে বোন নয়নতারাকেও ঢাকার ওই কারখানায় কাজে লাগিয়ে দেওয়া হয়। গত বছর করোনার কারণে বিধিনিষেধ ছিল। তার মধ্যেই ঈদের ছুটি হয়। গ্রামে ফেরার জন্য সব যানবাহন বন্ধ ছিল। এরপরও আলী আনছার ও বোন নয়নতারা মিলে ১২ মে ঢাকা থেকে গ্রামে ফেরার জন্য শিমুলিয়া ঘাটে পৌঁছান। ভিড়ের কারণে ভাই-বোন ফেরিঘাটে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। দুইজন দুই ফেরিতে চড়ে পদ্মা নদী পারি দিতে থাকেন। আলী আনছার যে ফেরিতে ওঠেন, সেখানে যাত্রীদের চাপে তিনি প্রাণ হারান। নয়নতারা তাঁর প্রাণবন্ত ভাইয়ের নিথর দেহ নিয়ে বাড়িতে ফেরেন।
রোববার সকালে কালিকা প্রসাদ গ্রামে আলী আনছারদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তাঁদের বাড়িতে ঈদের কোনো প্রস্ততি নেই। তাঁর ছোট দুই ভাইবোন মাদ্রাসায় পড়ালেখা করে। তাঁরা বাড়ির আঙিনায় খেলছিল। নির্মাণশ্রমিকের কাজ করার কারণে তাঁদের বাবা গিয়াস উদ্দিন মাদবর ঢাকায় থাকেন। ছোট দুই শিশুসন্তান নিয়ে মা নাছিমা বেগম গ্রামে থাকেন।
আলী আনছারের আরেক বোন আছমা আক্তার। তাঁর স্বামী দিনমজুরের কাজ করেন। ‘বাবার পরিবারকে কোনো সহায়তা করেন কি না’, এমন প্রশ্নে আছমা বলেন, ‘যা আয় হয় তা দিয়ে আমার সংসারই চলে না। বাবার পরিবারের পাশে দাঁড়াব কীভাবে? ভাইটা মারা যাওয়ার কারণে বাবার পরিবার বিপাকে পড়েছে। দেড় লাখ টাকা ঋণ করে টিনের ঘর নির্মাণ করা হয়েছিল। মা–বাবার চিকিৎসা করাতে আরও কিছু টাকা ঋণ করতে হয়েছে। মাসে ১০ হাজার টাকা করে সেই ঋণ পরিশোধ করতে হচ্ছে। তারপর সংসারের খরচ চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে ছোট বোন ও বাবাকে। আমাদের মতো গরিব মানুষের পরিবারে আবার ঈদের আনন্দ কিসের। রোজা শুরুর পর থেকেই প্রতিদিন ভাইয়ের জন্য মা কান্নাকাটি করেন। কারও জন্য জামাকাপড় কেনা হয়নি। এই কষ্টেও মা কান্না করেন।’
মা নাছিমা বেগম প্রথম আলোকে জানান, ‘সংসারে সুখ-স্বাচ্ছন্দ ফিরিয়ে আনায় ব্যস্ত ছিল আলী আনছার। সবকিছু স্তব্ধ করে সে চলে গেছে। এখন কোনো আনন্দই আর ভালো লাগে না। অভাবের সংসারে ছেলে হারানোর কষ্ট নিয়ে বেঁচে আছি। কেউ আমাদের পাশে নেই। প্রশাসন, সরকার এমপি কেউ খবর নেয় না। রমজানে টিসিবি থেকে দুই দফায় তেল, ডাল ও চিনি কিনেছিলাম। তা–ও মানুষের কাছ থেকে টাকা ধার করে। ছেলে হারানোর কষ্টের সঙ্গে ঋণ শোধ করার চাপও আমাকে কুরে কুরে খাচ্ছে।’
জানতে চাইলে নড়িয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শেখ রাশেদ উজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ফেরিতে যাত্রীর চাপে নিহত আলী আনছারের পরিবারের পাশে তাঁরা দাঁড়াবেন। তারা যদি সহায়তা চায়, তাহলে উপজেলা প্রশাসন তা বিবেচনা করে পদক্ষেপ নেবে।