সেদিন দুর্বৃত্তদের ‘আব্বা’ ‘ভাই’ বলে আকুতি জানিয়েও রক্ষা পাননি সেই নারী

নারী নির্যাতন
প্রতীকী ছবি

বিয়ের পর নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে বাবার বাড়িতে থাকতেন এক গৃহবধূ (৩৭)। এলাকার চিহ্নিত সন্ত্রাসী দেলোয়ার বাহিনীর সদস্যরা প্রায়ই তাঁকে নানাভাবে উত্ত্যক্ত করতেন এবং নানা খারাপ প্রস্তাব দিতেন। ২০২০ সালের ২ সেপ্টেম্বর রাত ৯টার দিকে দেলোয়ার বাহিনীর সদস্যরা হানা দেন ওই নারীর বাড়িতে। তাঁরা তাঁর স্বামীকে বাইরে নিয়ে বেঁধে রাখেন এবং নারীকে বিবস্ত্র করে ধর্ষণের চেষ্টা চালান। ব্যর্থ হয়ে নারীর ওপর নির্যাতন চালান এবং পুরো নির্যাতনের ভিডিও চিত্র ধারণ করেন।

১ মিনিট ৩৭ সেকেন্ডের সেই ভিডিও চিত্রে ওই নারীকে বারবার দেলোয়ার বাহিনীর সদস্যদের ‘ওরে আব্বারে, ভাইরে, তোগো আল্লাহর দোহাই...। ওরে ভাইরে, ওরে আব্বারে ছেড়ে দে...।’ এ সময় দুর্বৃত্তদের একজন বারবার ‘ফেসবুক হইবো, ফেসবুক’ বলতে থাকেন। নির্যাতনের ভিডিও চিত্র ধারণের পর দেলোয়ার বাহিনীর সদস্যরা ওই রাতে বাড়ি থেকে যাওয়ার পথে নারীকে ঘটনা কাউকে না জানাতে শাসিয়ে যান এবং জানালে প্রাণে মারার হুমকি দিয়ে যান।

নির্যাতনের সময় দেলোয়ার বাহিনীর ভয়ে ওই নারীকে রক্ষা করতে বাড়ির কিংবা আশপাশের কেউ এগিয়ে আসেননি। এতে ভীত-সন্ত্রস্ত নারী ঘটনার বিষয়ে বিচারপ্রার্থী না হয়ে জেলা শহরের হাউজিং এলাকায় বোনের বাসায় আশ্রয় নেন। কিন্তু তাতেও পিছু ছাড়েননি দেলোয়ার বাহিনীর সদস্যরা। তাঁরা নারীকে বারবার ফোন করে অনৈতিক প্রস্তাব দিতে থাকেন। আর প্রস্তাবে রাজি না হলে তাঁর কাছে থাকা ভিডিও চিত্রটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দেন।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ ওই নারী দেলোয়ার বাহিনীর কুপ্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় ধারণ করা ভিডিও চিত্রটি গত বছরের ৪ অক্টোবর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছেড়ে দেওয়া হলে ঘটনাটি জানাজানি হয়। এরপর তৎপর হয় পুলিশ প্রশাসন। তারা ওই দিনই নারীকে খুঁজে বের করে তাঁকে বাদী করে দেলোয়ার বাহিনীর ৯ সদস্যের নাম উল্লেখ করে থানায় দুটি মামলা করা হয়। এর মধ্যে একটি মামলা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে, অপরটি পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইনে।

ওই মামলা করার পর থানা-পুলিশ ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে প্রথম একজন আসামিকে গ্রেপ্তার করে। এরই মধ্যে নির্যাতনের ঘটনাটি সারা দেশে তোলপাড় সৃষ্টি করে। ২০২০ সালের ৬ জুন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের তদন্ত দল নোয়াখালীতে এলে নারী তাঁদের কাছে অভিযোগ করেন, দেলোয়ার বাহিনীর প্রধান দেলোয়ার এর আগে তাঁকে দুবার ধর্ষণ করেছিলেন। কিন্তু ভয়ে তিনি মামলা করতে সাহস পাননি। পরে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সহায়তায় নারী বাদী হয়ে দেলোয়ার বাহিনীর প্রধান দেলোয়ার ও তাঁর সহযোগী আবুল কালামের বিরুদ্ধে বেগমগঞ্জ থানায় আরেকটি মামলা করেন।

গত বছরের ৭ অক্টোবর মামলা দুটির তদন্তভার গ্রহণ করে পিবিআই। তদন্তে নারীকে মারধর, বিবস্ত্র করে নির্যাতন ও ধর্ষণচেষ্টার মামলায় দেলোয়ার বাহিনীর প্রধান দেলোয়ার হোসেন ওরফে দেলুসহ ১৪ জনের বিরুদ্ধে ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে। যাঁদের মধ্যে এজাহারভুক্ত আসামি আটজন, আর এজাহারবহির্ভূত আসামি ছয়জন।

পিবিআই সূত্র জানায়, গ্রেপ্তার ১২ আসামির মধ্যে ৮ জন দোষ স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। তাঁরা হলেন নুর হোসেন ওরফে বাদল, মো. রহিম, মাঈন উদ্দিন ওরফে সাজু, মোহাম্মদ আলী ওরফে আবু কালাম, ইস্রাফিল হোসেন ওরফে মিয়া, মোয়াজ্জেম হোসেন ওরফে সোহাগ মেম্বার, নুর হোসেন ওরফে রাসেল ও আনোয়ার হোসেন ওরফে সোহাগ।

১৫ ডিসেম্বর আদালতে আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করে পিবিআই। এরপর গত ২৪ মার্চ আদালতে অভিযোগপত্রভুক্ত ১৩ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে। এরপর বিচারপ্রক্রিয়া চলাকালে আদালত ৪০ সাক্ষীকে পরীক্ষা করা হয়।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ ৬ ডিসেম্বর নোয়াখালীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-১–এ নারীকে বিবস্ত্র করে ধর্ষণের চেষ্টা ও নির্যাতনের মামলার আর্গুমেন্ট শুনানি শেষ হয়। ওই দিনই আদালতের বিচারক (জেলা ও দায়রা জজ) জয়নাল আবেদিন মামলার রায় ঘোষণার দিন নির্ধারণ করেন আজ মঙ্গলবার। রায়ে আদালত মামলার ১৩ আসামির প্রত্যেকের ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড, ৫০ হাজার টাকা জরিমানা এবং অনাদায়ে আরও ৩ মাসের কারাদণ্ডের আদেশ দেন।

এর আগে চলতি বছরের ৪ অক্টোবর একই আদালতে ওই নারীকে ধর্ষণের ঘটনায় করা অপর মামলায় অভিযুক্ত দেলোয়ার বাহিনীর প্রধান দেলোয়ার হোসেন ও তাঁর সহযোগী আবুল কালামের যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়।