সেবার পাশাপাশি সৃজনশীলতা

‘স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাতীয় পুরস্কার-২০২০’-এর দুটি ক্যাটাগরিতে প্রথম ও তৃতীয় হওয়ার সাফল্য দেখিয়েছে এই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স।

মো. আলমগীর

কেশবপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নারী ওয়ার্ডে প্রবেশ করতেই অন্তর কবিরত্নের হাতে দেখা গেল ‘শেষের কবিতা’ বই। তিনি তাঁর ৮০ বছর বয়সী অসুস্থ দাদি ইরা কবিরত্নকে চিকিৎসা করাতে নিয়ে এসেছেন। তাঁর পা ভেঙে গেছে। রক্তশূন্যতা নিয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন রূপালী বেগম (৪০। তাঁর হাতে ‘জান্নাতি ১০ রমণীর জীবনী’ বইটি। হাসপাতালে বই কেন, মনে খটকা লাগতেই পারে। এই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সুচিকিৎসার পাশাপাশি সৃজনশীলতায় অনন্য।

এসব গুণ হাসপাতালটিকে এনে দিয়েছে দেশসেরার তকমা। ‘স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাতীয় পুরস্কার-২০২০’–এর দুটি ক্যাটাগরিতে প্রথম ও তৃতীয় হওয়ার সাফল্য দেখিয়েছে এই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। চিকিৎসাসেবার পাশাপাশি রোগীদের মন ফুরফুরে রাখতে হাসপাতালের নারী ও পুরুষ ওয়ার্ডে আছে গ্রন্থাগার। সেখান থেকে পছন্দমতো বই নিয়ে পড়তে পারেন রোগী ও স্বজনেরা। আছে পত্রিকা পড়ার ব্যবস্থাও। হাসপাতালের পরিবেশও পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন।

সুফলাকাটি গ্রাম থেকে আসা দীপালী রানী মণ্ডল (৪৫) এসেছেন বুকে ব্যথা নিয়ে। তাঁকে কয়েকটি পরীক্ষা দেওয়া হয়েছে। মঙ্গলবার বেলা দুইটা হাসপাতালের বহির্বিভাগ বন্ধ। সেখানে কোনো চিকিৎসক পাচ্ছিলেন না তিনি। চলে যান তখন হাসপাতালটির প্রধান, উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা আলমগীরের কাছে। এই চিকিৎসক রানী মণ্ডলকে দেখার পাশাপাশি আরো সাত–আটজন রোগী দেখে চিকিৎসাপত্র দেন। সবাইকে দেখে আলমগীর জানতে চান, আরও কেউ আছেন কি না। কেউই যেন খালি হাতে ফিরে না যান।

এ পুরস্কারের জন্য সম্মিলিত প্রয়াস বেশি কাজ করেছে। এখন আরও বড় চ্যালেঞ্জ হলো, সাফল্য ধরে রাখা এবং আরও ভালো করা।
মো. আলমগীর, স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা, কেশবপুর

ইজিবাইকের ধাক্কায় আহত হয়ে এই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা নিচ্ছেন মোছা. মুরশিদা ও তাঁর তিন বছর বয়সী ছেলে মিখাইল। মুরশিদা বলেন, তিন দিন ধরে হাসপাতালে ভর্তি তিনি। ভালোই চিকিৎসা পাচ্ছেন। চিকিৎসকেরা দুই বেলা দেখছেন। হাসপাতাল থেকে কিছু ওষুধও পেয়েছেন। বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিয়ে সত্যজিৎ বিশ্বাস বলেন, হাসপাতালে একটু ভিড় হয়। তারপরও ডাক্তার দেখানো যায়।

স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ আয়েশা আক্তার বলেন, কেশবপুরের পাশাপাশি মনিরামপুরের হাসপাতালেও প্রসূতিদের সিজার করেন তিনি। দুই জায়গায় দায়িত্ব পালন করা একটু কষ্টের হয়। তারপরেও রোগীরা সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরলে ভালো লাগে তাঁর।

স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাতীয় পুরস্কারে কমিউনিটি ক্লিনিক সার্ভিস ক্যাটাগরিতে দেশসেরা হয়েছে। স্বাস্থ্যসেবায় তৃতীয় স্থান অর্জন করেছে। এই ক্যাটাগরিতে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি এবার নিয়ে চারবার পুরস্কৃত হয়েছে। এর আগে দুইবার দ্বিতীয় ও একবার তৃতীয় হয়। গত ৩১ মার্চ রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে পুরস্কার দুটি কেশবপুর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা আলমগীর হোসেনের হাতে তুলে দেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। ১৭২টি মানদণ্ড বিবেচনায় পুরস্কার দুটি পায় কেশবপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স।

এই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আওতাধীন উপজেলায় ছয়টি কমিউনিটি ক্লিনিকও ভালো চলছে। মঙ্গলবার ক্লিনিকগুলো ঘুরে দেখা গেছে, একেকটি ক্লিনিকে প্রতিদিন ৪০ জন রোগী দেখার কথা থাকলেও কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডাররা ৬০ জন করে রোগী দেখেছেন। ২০২০ সালে ৪ হাজার ৮৯০ জন রোগীকে সেবাদানের টার্গেট থাকলেও ৫ হাজার ৫৪৮ জনকে সেবা দেওয়া হয়েছে। প্রসূতিদের স্বাভাবিক প্রসব করানোর জন্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডাররা সব সময় তৎপর থাকেন। চাঁড়দা কমিউনিটি ক্লিনিকের কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার রেশমা খাতুন বলেন, গত তিন মাসে তাঁর ক্লিনিকে সাতটি স্বাভাবিক প্রসব হয়েছে। সবাই ভালো আছে।

যাঁর হাত ধরে এই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটির বদলে যায়, তিনি হলেন এই হাসপাতালের সাবেক চিকিৎসক শেখ আবু শাহীন। তাঁর অধীনেই স্বাস্থ্যসেবায় ২০১৭ ও ২০১৮ সালে দ্বিতীয়, ২০১৯ সালে তৃতীয় ও ২০২০ সালে তৃতীয় হয়। ২০২০ সালে কমিউনিটি ক্লিনিকের প্রথম হওয়ার পেছনেও তাঁর অবদান রয়েছে। বর্তমানে তিনি খুলনার বিশেষায়িত আবু নাসের হাসপাতালের পরিচালক হিসেবে কর্মরত। উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মো. আলমগীর বলেন, এ পুরস্কারের জন্যে সম্মিলিত প্রয়াস বেশি কাজ করেছে। এখন আরও বড় চ্যালেঞ্জ হলো, সাফল্য ধরে রাখা এবং আরও ভালো করা।