স্পিডবোটডুবিতে তিন মেয়েকে হারিয়ে অশ্রুভেজা ঈদ আলাউদ্দিনের
মো. আলাউদ্দিনের জীবনে একটি ঈদও করা হলো না মেয়েদের সঙ্গে। ২৪টি বছর কাটিয়েছেন প্রবাসে। তিন মেয়ের জন্মের পর তাদের সঙ্গেও ভিডিও কলেই ঈদ করতে হয়েছে। এবার ঈদে যখন দেশে রয়েছেন, সন্তানেরা আর এ পৃথিবীতে নেই। গত ২০ এপ্রিল চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ উপকূলে স্পিডবোট দুর্ঘটনায় তিন সন্তানই মারা গেছে।
তিন সন্তানকে হারানো ওমানপ্রবাসী মো. আলাউদ্দিন আজ মঙ্গলবার অশ্রুভেজা ঈদ পালন করছেন। সকাল থেকেই অঝর ধারায় কান্না করে চলেছেন স্ত্রী পান্না বেগম। তাঁকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা কারও নেই। এরপরও স্বজনেরা আলাউদ্দিন-পান্না দম্পতিকে বারবার সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
সন্তানহারা এই দম্পতির বাড়ি সন্দ্বীপের মগধরা ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডে। দুর্ঘটনার দিন তাঁদের বড় মেয়ে আনিকার (১২) লাশ উদ্ধার হলেও নিখোঁজ ছিল যমজ (৮) মেয়ে আদিবা ও আলিফার দেহ। দুদিন পর ২২ এপ্রিল সন্দ্বীপের বিচ্ছিন্ন ইউনিয়ন উড়িরচরের উপকূল থেকে আদিবার লাশ উদ্ধার করে উদ্ধারকারীরা। বিদেশ যাওয়ার নয় দিনের মাথায় ওই দিনই আলাউদ্দিন বিদেশ থেকে দেশে ফিরে আসেন। দুর্ঘটনার ১৩ দিন পেরোলেও এখনো আলিফার লাশ উদ্ধার করতে পারেননি উদ্ধারকারীরা।
আলাউদ্দিন প্রথম আলোর সঙ্গে যখন কথা বলছিলেন, তখন তিনি অঝর ধারায় কাঁদছিলেন। আক্ষেপ করে তিনি বলেন, ‘জীবনের ২৪টি বছর প্রবাসজীবনে কাটিয়েছি সন্তানদের ভবিষ্যৎ ও পরিবারের সুখশান্তির কথা চিন্তা করে। কিন্তু আমি এত দুর্ভাগা বাবা যে একটিবারও আমার মেয়েদের সঙ্গে ঈদ কাটাতে পারিনি। মেয়েরা প্রতিবার ঈদের আগে আমাকে দেশে আসার জন্য কত কাকুতিমিনতি করত। বলতাম, মা রে, আগামী ঈদে তোদের সঙ্গে কাটাব। এই করতে করতে মেয়েদেরই হারিয়েই ফেললাম। মেয়েদের সঙ্গে ঈদ কাটানো আর হলো না।’
জীবনের ২৪টি বছর প্রবাসজীবনে কাটিয়েছি সন্তানদের ভবিষ্যৎ ও পরিবারের সুখশান্তির কথা চিন্তা করে। কিন্তু আমি এত দুর্ভাগা বাবা যে একটিবারও আমার মেয়েদের সঙ্গে ঈদ কাটাতে পারিনি। মেয়েরা প্রতিবার ঈদের আগে আমাকে দেশে আসার জন্য কত কাকুতিমিনতি করত। বলতাম, মা রে, আগামী ঈদে তোদের সঙ্গে কাটাব। এই করতে করতে মেয়েদেরই হারিয়েই ফেললাম।
এবার ঈদে মেয়েরা অনেক আনন্দ করতে চেয়েছিল জানিয়ে আলাউদ্দিন বলেন, ‘সামনে ঈদ, অথচ আমি চলে যাচ্ছিলাম মেয়েদের ছেড়ে প্রবাসে। তাই মেয়েরা ঈদে পরার জন্য যা চেয়েছে, তা কিনে দিয়েছিলাম। প্রতিজনের জন্য চার জোড়া করে পোশাক কিনেছিলাম। পোশাকের সঙ্গে মিলিয়ে জুতাও কিনে দিয়েছিলাম। ছোট মেয়ে (যমজ) দুটি একই রকম পোশাক কিনেছিল। ঈদ এসেছে ঠিকই, কিন্তু আমার মেয়েরা পরে যেতে পারল না সেই পোশাক।’ মিনিট দুয়েকও কথা বলতে পারছিলেন না তিনি। চোখ আর গলা জলে ভিজে আসছিল।
আলাউদ্দিন বলেন, ‘গত ১৪ এপ্রিল মেয়েদের বিদায় দিয়ে প্রবাসে পাড়ি জমিয়েছিলাম। আমাকে বিদায় দিয়ে মেয়েরা চিরবিদায় নিল। আর বাড়ি ফিরল না। আমার মেয়েদের নিয়ে কত স্বপ্ন ছিল। আমার তিনটা মেয়েই মেধাবী ছিল। বাংলা, আরবি, গণিত ও ইংরেজিতে পারদর্শী ছিল। বড় মেয়ের ইচ্ছা ছিল সে ডাক্তার হবে। যমজ দুজনেই শিক্ষক হতে চেয়েছিল। আমি পারলাম না তাদের ইচ্ছে পূরণ করতে।’
আলাউদ্দিন বলেন, ‘মেয়েরা নেই। ঘর ফাঁকা। বাড়িতে আমার একদম ভালো লাগে না। তাই আবারও চলে যাব ওমানে। আগেই চলে যেতাম। কিন্তু স্বজনদের ইচ্ছায় আগামী কোরবানির ঈদ পর্যন্ত থাকব। এরপর চলে যাব।’
ঈদের দিন সন্তানদের শূন্যতা কিছু সময়ের জন্য ভোলাতে শ্যালক ওসমান গণি বোন-দুলাভাইকে তাঁর বাড়িতে নিয়ে আসেন। সকাল নয়টার দিকে দুলাভাই আলাউদ্দিনকে নিয়ে ঈদগাহের দিকে রওনা দেন ওসমান গণি। সাদা পাঞ্জাবি, টুপি ও লুঙ্গি পরে ঈদের নামাজ আদায় করেন আলাউদ্দিন। ঈদের নামাজ শেষে দুই মেয়ের কবর জিয়ারত করেন তিনি। এ সময় তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন। পরে স্বজনেরা আলাউদ্দিনকে সান্ত্বনা দিয়ে বাড়ি নিয়ে আসেন।
আলাউদ্দিনের শ্যালক ওসমান গণি প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের ও বোনের পরিবারে এবার অশ্রুভেজা ঈদ কাটছে। ১৩ দিন ধরে মেয়েদের জন্য কাঁদতে কাঁদতে তাঁর বোন পান্না বেগম অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তাঁদের সান্ত্বনা দিতে তিনি কর্মস্থল থেকে বাড়িতে ফিরেছেন। সান্ত্বনা দেওয়া ছাড়া তো আর কিছুই করার নেই। মেয়েরা নতুন পোশাক পরে ঈদ করতে পারেনি, এ কারণে তাঁর বোন-দুলাভাই নতুন পোশাক কেনেননি। তিনি লুঙ্গি ও পাঞ্জাবি কিনে দিয়েছিলেন। সেগুলো পরতে চায়নি। একরকম জোর করে পরিয়েছেন তিনি। সকাল থেকে বাড়িতে চলছে মাতম। গত বছরও ঈদের দিনে তাঁর বোনের মেয়েরা কত আনন্দ করেছিল। নতুন পোশাক পরে এদিক-ওদিক ছুটোছুটি করেছিল। এবার পুরো বাড়ি শূন্য হয়ে আছে।