স্বামীহারা তানিয়ার সংসার চলবে কীভাবে

বাড়ির আঙিনায় গত রোববার গাড়ির সিলিন্ডার বিস্ফোরণে দগ্ধ হন পথচারী জজ মিয়া। সোমবার সকালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয়। স্বামীর মৃত্যুতে শেফালী বেগমের আহাজারি
ছবি: দিনার মাহমুদ

ট্রাক চালিয়ে প্রতিদিন আড়াই শ থেকে তিন শ টাকা পেতেন আলম হোসেন (৪০)। মাসে ১ হাজার ৬০০ টাকা ভাড়ায় এক রুমের ঘরে স্ত্রী ও দুই সন্তানকে নিয়ে থাকতেন। বড় মেয়ে আফরিন (১২) ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে। ছোট মেয়ে তানহা (৬) এ বছর মাদ্রাসায় ভর্তি হয়েছে। স্ত্রী তানিয়া আক্তার ডায়াবেটিসসহ নানা রোগে আক্রান্ত। আলমের উপার্জনের টাকা দিয়েই সংসার চলত তাঁদের। একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তির মৃত্যুতে এখন দিশাহারা পরিবারটি। দুই সন্তান নিয়ে অসুস্থ তানিয়ার সংসার এখন কীভাবে চলবে ভেবে পান না স্বজনেরা।

রোববার দুপুরে নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার ফতুল্লার ব্যাপারীবাড়ি এলাকায় প্রতিবেশী আবদুল বাতেন ট্রাকের সিলিন্ডার থেকে গ্যাস অপসারণ করার সময় বিস্ফোরণে দগ্ধ হন ট্রাকচালক আলম হোসেন (৪০) ও ট্রান্সপোর্ট ব্যবসায়ী জজ মিয়া (৫০)। রাজধানীর শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আজ সোমবার সকালে এই দুজনের মৃত্যু হয়। নিহত জজ মিয়া আলীগঞ্জ এলাকার মজিবুর রহমানের ছেলে। আলম হোসেন ব্যাপারীবাড়ি এলাকার তালেব মিয়ার ছেলে।

জজ মিয়ার নিজের ট্রাক না থাকলেও ভাড়া করা ট্রাকের মাধ্যমে মালামাল পরিবহন করতেন। সেই আয় দিয়ে স্ত্রী, দুই ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে চলত তাঁর সংসার। তাঁকে হারিয়ে ওই পরিবারেও নেমে এসেছে অনিশ্চয়তা।

এলাকাবাসী ও বিস্ফোরণে হতাহতের পরিবারের লোকজন বলেন, ৩ ফুট চওড়া ওই সড়কের আশপাশের অনেকগুলো টিনের বাড়ি। প্রতিবেশীরা নিষেধ করার পরও ঘিঞ্জি ওই সড়কে বসে সিলিন্ডার থেকে গ্যাস অপসারণ করছিলেন ট্রাকমালিক ও চালক আবদুল বাতেন। তাঁর এমন কাজের জন্য দগ্ধ হয়ে দুজনের প্রাণ গেল। বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন আছেন দগ্ধ তিনজন।

নিহত আলম হোসেনের মামাশ্বশুর মজিবর রহমানের আলীগঞ্জের বাড়িতে বসে সোমবার দুপুরে কথা হয় আলমের স্ত্রী তানিয়ার খালাতো বোন আঁখি আক্তারের সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, আলম যা আয় করতেন, তাতে চারজনের সংসার ঠিকমতো চলত না। তানিয়া দুই সন্তান নিয়ে এখন কীভাবে সংসার চালাবেন?

আলমের মামাশ্বশুর মজিবর রহমান বলেন, একটি বিস্ফোরণে কয়েকটি পরিবার তছনছ হয়ে গেল। যাঁরা বেঁচে আছেন, তাঁদের অবস্থাও ভালো নয়। পরিবারগুলোর আর্থিক সামর্থ্য নেই দগ্ধদের চিকিৎসার করানোর। নিহত দুজনের পরিবারে আর্থিক সহায়তা ও দগ্ধদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।

নিহত জজ মিয়ার বড় ছেলে সিয়াম হোসেন (২২) রাজমিস্ত্রির কাজ করেন। ছোট ছেলে সিফাত স্থানীয় মাদ্রাসায় কিতাবখানায় পড়াশোনা করছেন। মেয়ে সুমাইয়া আক্তার (১৪) নবম শ্রেণির ছাত্রী। ২ শতাংশ জমিতে সাতটি টিনশেড ঘর নির্মাণ করে তিনটিতে পরিবার নিয়ে নিজে থাকতেন জজ মিয়া। অপর চারটি ঘর ভাড়া দিয়েছেন। সিয়াম হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, গত শনিবার রাতে আবদুল বাতেন তাঁদের বাড়ির গেটের ভেতরে গ্যাস সিলিন্ডারটি এনে রাখেন। গতকাল সকালে তাঁর বাবা কয়েকবার বলার পর সেটি বের করে বাসার সামনের সড়কে নিয়ে গ্যাস অপসারণ করতে থাকেন। এ সময় শোঁ শোঁ শব্দ হতে থাকে। বাতেনের সঙ্গে একজন মিস্ত্রিও ছিলেন। সেখানে আলম গিয়ে সিগারেট ধরালে বিকট শব্দে সিলিন্ডারটির বিস্ফোরণ ঘটে। এতে তাঁর বাবাসহ ১০ জন দগ্ধ হন।

জজ মিয়ার বাড়ির ভাড়াটে রাজমিস্ত্রি রাকিবুল হাসান বলেন, ঘরের ভেতরে আগুন দেখে তিনি বেড়া ভেঙে অন্য ঘরে গিয়ে প্রাণ বাঁচান। আগুনে তাঁর ভাবি শেফালি ও ভাতিজি হাফসা দগ্ধ হন।

নিহত জজ মিয়ার মেয়ে সুমাইয়া আক্তার বলেন, নামাজ পড়তে যাবেন বলে তাঁর বাবা গোসল করে লুঙ্গি শুকাতে দিচ্ছিলেন। এমন সময় বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে। ঘটনার পর আগুনে পুড়ে তাঁর বাবার শরীরের চামড়া খুলে খুলে পড়ছিল। সুমাইয়া বলেন, ‘আমরা বাতেনের বিচার চাই। ক্ষতিপূরণ চাই।’

এদিকে সোমবার দুপুরে আবদুল বাতেনের বাড়িতে গেলে ঘরের দরজায় তালা মারা পাওয়া যায়। আগুনে বাতেনের স্ত্রী আসমা বেগম ও তাঁর মেয়ে তোহাও দগ্ধ হয়েছেন। ঘটনার পর থেকে আবদুল বাতেন কোথায় আছেন কেউ বলতে পারেন।

এ বিস্ফোরণের বিষয়ে ফতুল্লা মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রকিবুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, এ ঘটনায় কেউ মামলা করেনি। তবে পুলিশের পক্ষ থেকে একটি জিডি করা হয়েছে।