হস্তীশাবককে পোষ মানাতে ‘হাদানি’র মতো নিষ্ঠুরতার প্রয়োজন নেই

সোহেল শ্যাম

হস্তীশাবককে পোষ মানানোর প্রাচীন পদ্ধতি হচ্ছে ‘হাদানি’। এই পদ্ধতিতে হস্তীশাবককে মা থেকে দূরে রেখে, বেঁধে, শারীরিক নির্যাতন করে এবং প্রয়োজনমতো খেতে না দিয়ে বশে আনার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এটি বন্য প্রাণীর প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ। মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলায় এ রকম পদ্ধতিতে হস্তীশাবককে পোষ মানানোর খবর গণমাধ্যমে আসে। ৭ ফেব্রুয়ারি এমন নিষ্ঠুরতা বন্ধ করতে নির্দেশ দেন মৌলভীবাজারের আদালত। বিষয়টি নিয়ে প্রথম আলো কথা বলেছে মৌলভীবাজারের বন্য প্রাণী সংরক্ষণ ও উদ্ধারের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন স্ট্যান্ড ফর আওয়ার এনডেঞ্জার্ড ওয়াইল্ডলাইফের (এসইডব্লিউ) অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সোহেল শ্যামের সঙ্গে।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: হস্তীশাবককে পোষ মানানোর প্রাচীন পদ্ধতি ‘হাদানি’। পদ্ধতিটিকে কি গ্রহণযোগ্য মনে করেন? এ রকম নির্মম পদ্ধতি অনুসরণ করার কোনো প্রয়োজন আছে?

সোহেল শ্যাম: ‘হাদানি’ একটি প্রাচীন পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে হস্তীশাবককে মায়ের কাছ থেকে আলাদা রাখা হয়। প্রায় এক থেকে দুই মাস শাবককে চার পা বেঁধে রেখে নির্মমভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। বড় বড় গাছ টানানোসহ বিভিন্ন শারীরিক কসরত শেখানো হয়। কিন্তু বর্তমান সময়ে এই নির্মম পদ্ধতিকে অনুসরণের কোনো প্রয়োজন নেই। বাংলাদেশে আসলে হস্তীশাবককে প্রশিক্ষণ দেওয়ার মতো কোনো প্রশিক্ষিত লোক নেই। যে কারণে প্রাচীন পদ্ধতিতেই হস্তীশাবককে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। বন্য প্রাণী আইনেও (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন ২০১২) হস্তীশাবককে প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো নীতিমালা নেই।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: একসময় হাতি দিয়ে পাহাড়ে গাছ টানানো হতো। এখন তো প্রযুক্তিগত অনেক উন্নয়ন ঘটেছে। হাতির চেয়ে আরও সহজভাবে এই কাজটি করা যায়। সে ক্ষেত্রে বন্য প্রাণীকে এই কাজে ব্যবহারের দরকার আছে?

সোহেল শ্যাম: বর্তমানে আমরা প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে অনেক এগিয়েছি। অনেক আধুনিক যন্ত্রপাতি আবিষ্কৃত হয়েছে। এসব যন্ত্রপাতি আমরা বন্য প্রাণীর পরিবর্তে ব্যবহার করতে পারি। এ পর্যায়ে এসে হাতির মতো বিলুপ্তপ্রায় নিরীহ বন্য প্রাণীকে গাছ টানানোর মতো এমন নির্মম ও যন্ত্রণাদায়ক কাজে ব্যবহারের কোনো যৌক্তিকতা নেই।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: বন্য প্রাণী সুরক্ষায় আইন আছে। ‘হাদানি’র মতো নির্মম পদ্ধতিতে হস্তীশাবক পোষ মানানোর ঘটনা প্রতিরোধে বন বিভাগসহ স্থানীয় প্রশাসনের সক্রিয়তা কেমন?

সোহেল শ্যাম: যতটুকু দেখেছি, এই ঘটনায় বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ সিলেটের ভূমিকা বেশ সক্রিয় ছিল। বিষয়টি জানার সঙ্গে সঙ্গেই বন বিভাগ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে হস্তীশাবককে মুক্ত করে। যাঁরা প্রশিক্ষণ দিচ্ছিলেন, তাঁদের এমন নির্মমভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া যাবে না বলে জানান। বন্য প্রাণীর প্রয়োজনীয়তা, বন্য প্রাণী আইনের বিষয়ে প্রচার-প্রচারণা বাড়ানো দরকার। বন বিভাগে আরও জনবল বাড়ানো দরকার।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: হস্তীশাবককে পোষ মানানোর এই নির্মম পদ্ধতি, প্রক্রিয়া বন্ধে আদালত স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে একটি নির্দেশ দিয়েছেন। বন্য প্রাণী রক্ষায় এই নির্দেশকে আপনি কীভাবে দেখছেন?

সোহেল শ্যাম: আদালতের এই নির্দেশ বন্য প্রাণী রক্ষার ক্ষেত্রে খুবই ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। বন্য প্রাণীর ওপর যা খুশি তা–ই যে করা যায় না, মানুষের মধ্যে এ নিয়ে সচেতনতা তৈরি হবে। বন্য প্রাণী আমাদের পরিবেশ-প্রতিবেশের অংশ, মানুষের মতো তাদেরও প্রকৃতিতে বেঁচে থাকার অধিকার আছে—মানুষের মধ্যে এই ধারণা পোক্ত হবে।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: অনেক দিন ধরে আপনি ও আপনাদের সংগঠন বিপন্ন ও বিলুপ্তপ্রায় বন্য প্রাণী রক্ষায় কাজ করছেন। বন্য প্রাণীর অবস্থা এখন কেমন? বন্য প্রাণী রক্ষায় কী কী করা দরকার?

সোহেল শ্যাম: গত কয়েক দশকে দেশে বন্য প্রাণীর অনেক প্রজাতি হুমকির মুখে পড়েছে। অনেক প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তবে আমরা এখন অনেকটাই আশার আলো দেখতে পাই। সরকার, বন বিভাগ ও কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এসব বিপন্ন বন্য প্রাণী রক্ষা ও সংরক্ষণে কাজ করে যাচ্ছে। এতে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বেড়েছে। বন্য প্রাণী রক্ষায় নতুন প্রজন্মকে সম্পৃক্ত করতে হবে। বন্য প্রাণী–সম্পর্কিত আইন ও বন্য প্রাণীর গুরুত্ব পাঠ্য বইয়ে অন্তর্ভুক্ত করা দরকার। বাংলাদেশে কোন প্রজাতির বন্য প্রাণীর পরিবেশগত মূল্য কী, সেটা নিয়ে কোনো গবেষণা নেই। একটা প্রজাতির পরিবেশগত মূল্য কতটুকু, বন্য প্রাণী রক্ষা ও সংরক্ষণে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তাই বিষয়টির প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে।

আরও পড়ুন