হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণ এখন লাভজনক ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। কৃষকদের স্বার্থে সরকার প্রতিবছর কোটি কোটি টাকা দেয়, কিন্তু যাঁরা কাজ বাস্তবায়নের সঙ্গে যুক্ত, তাঁরা কৃষকের নয়, নিজেদের স্বার্থ বড় করে দেখেন। পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) ও প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা, স্থানীয় রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক প্রভাবশালীর মিলে হাওরে বাঁধ সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন। যে কারণে কাজে দুর্নীতি, অনিয়ম হচ্ছে। বাঁধের নামে টাকার অপচয় ও লুটপাট হয়। এতে কপাল পোড়ে কৃষকের।
হাওর অ্যাডভোকেসি প্ল্যাটফর্ম (হ্যাপ) নামের একটি সংগঠন এক সংবাদ সম্মেলনে এসব অভিযোগ তুলে ধরে। সংগঠনটির প্রতিনিধিরা দুদিন জেলার ক্ষতিগ্রস্ত বিভিন্ন হাওর ও বাঁধ ঘুরে আজ সোমবার দুপুরে সুনামগঞ্জ পৌর শহরের শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পাবলিক লাইব্রেরিতে এই সংবাদ সম্মেলন করেন। এতে মূল বক্তব্য তুলে ধরেন সংগঠনের যুগ্ম আহ্বায়ক শরিফুজ্জামান। হাওরের নানা সংকট নিয়ে কথা বলেন সুনামগঞ্জে হাওরের কৃষি ও কৃষক রক্ষা সংগ্রাম পরিষদের সদস্যসচিব অধ্যাপক চিত্তরঞ্জন তালুকদার, হ্যাপের সদস্য ইয়াহিয়া সাজ্জাদ, সুনামগঞ্জ হাওর বাঁচাও আন্দোলনের নেতা নির্মল ভট্টাচার্য।
দুদিন সুনামগঞ্জ জেলার তিনটি উপজেলার পাঁচটি হাওর ঘুরে দেখেন সংগঠনের প্রতিনিধিরা। সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, একসময় হাওরে ঠিকাদারদের মাধ্যমে ফসল রক্ষা বাঁধের কাজ হতো। কিন্তু ২০১৭ যে ফসলডুবির পর ঠিকাদারি প্রথা বাদ দিয়ে স্থানীয় কৃষক ও সুবিধাভোগীদের নিয়ে গঠিত প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির (পিআইসি) মাধ্যমে কাজ হচ্ছে। বেশি মানুষকে সম্পৃক্ত করে কাজ করার এই পদ্ধতিটি গ্রহণযোগ্য। প্রথম দুই–এক বছর কাজ ভালোই হয়েছে, এখন এটিকে নিষ্ক্রিয় করা, বিতর্কিত করার একটা ষড়যন্ত্র চলছে।
সংবাদ সম্মেলনে দাবি করা হয়, কমিটিতে নামে-বেনামে স্থানীয় রাজনৈতিক, অরাজনৈতিক প্রভাবশালীরা ঢুকে পড়েন। তাঁরা পিআইসি নিজেদের কবজায় নিয়ে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছেন। সরকারি টাকা লুটপাট হচ্ছে। এতে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের যোগসাজশ আছে। এ কারণেই বাঁধের কাজ হয় দায়সারাভাবে, সময়মতো কাজ শুরু ও শেষ করা যায় না। এবারও দেখা গেছে, বাঁধ নির্মাণ যেমন যথাযথভাবে হয়নি, তেমনি রক্ষণাবেক্ষণ ও তদারকির দায়িত্বটিও ঠিকমতো হয়নি। এখন পাহাড়ি ঢল আসায় দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়েছে। এক পক্ষ আরেক পক্ষকে দোষারোপ করছে।
এ সংকট থেকে উত্তরণে হাওর এলাকার নদ-নদী খনন জরুরি বলে উল্লেখ করা হয় সংবাদ সম্মেলনে। বক্তারা বলেন, বাঁধ নির্মাণে পিআইসি পদ্ধতি রাখতে হবে। তবে অনিময় ও দুর্নীতিমুক্ত করতে পিআইসির সংস্কার দরকার। কাজে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখতে হবে। প্রশাসন ও পাউবো কর্মকর্তাদের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। বিশেষ করে কাজ অবশ্যই যথাসময়ে শুরু এবং শেষ করতে হবে। এবার যাঁরা বাঁধের অনিয়মের সঙ্গে যুক্ত, তদন্ত করে তাঁদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে। সুনামগঞ্জে এবার হাওরের ফসল রক্ষায় ৭২৭টি প্রকল্পে ১২২ কোটি টাকার বাঁধের কাজ হয়েছে। তবে এবারও কাজ সময়মতো শেষ হয়নি।
গত ৩০ মার্চ থেকে ভারতের মেঘালয় ও চেরাপুঞ্জি থেকে নামা পাহাড়ি ঢলে সুনামগঞ্জে অস্বাভাবিকভাবে পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে ঝুঁকিতে পড়েছে জেলার সব হাওরের বোরো ফসল। ২ এপ্রিল প্রথমে তাহিরপুর উপজেলার টাঙ্গুয়ার হাওরের একটি বাঁধ ভেঙে ফসল তলিয়ে যায়। এরপর একে একে ছোট-বড় আরও ১০টি হাওরের ফসলহানি ঘটেছে। তবে জেলার বড় বড় হাওরগুলোর ফসলের এখনো ক্ষতি হয়নি।
জেলা কৃষি বিভাগের হিসাবমতে, এবার সুনামগঞ্জে ২ লাখ ২২ হাজার ৮০৫ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে। ধানের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৩ লাখ ৫০ হাজার ২২০ মেট্রিক টন। এবারের ঢলে জেলার বিভিন্ন হাওরে প্রায় পাঁচ হাজার হেক্টর জমির ধানের ক্ষতি হয়েছে। এ পর্যন্ত ধান কাটা হয়েছে ২ হাজার ৬০০ হেক্টর।
জেলা প্রশাসক জাহাঙ্গীর হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ১০ দিন ধরে তাঁরা হাওরের ফসল রক্ষায় দিন–রাত কাজ করছেন। এটা এক অন্য রকম লড়াই। কিন্তু যে হারে পানির চাপ বাড়ছে, সেটিতে তাঁরা আতঙ্কিত। অনেক স্থানে বাঁধ দুর্বল হয়ে পড়েছে। এত দিন সুনামগঞ্জে বৃষ্টি ছিল না। রোববার থেকে থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে। এখন আবার ঢল এলে, পানির চাপ বাড়লে, অনেক স্থানে সমস্যা হতে পারে। তবে প্রশাসনের লোকজন মাঠে আছেন। হাওরের ফসল রক্ষার সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হচ্ছে।