সিলেট নগরের জল্লারপাড় ওয়াকওয়েতে প্রতিদিন রাতে ভিড় করছেন হাজারো মানুষ। একই সঙ্গে চলছে আড্ডা আর খাওয়া–দাওয়া। শুক্রবার রাত ১১টার দিকে
ছবি : প্রথম আলো

খড়ের ছাউনি আর বাঁশের খুঁটি দিয়ে তৈরি উন্মুক্ত ঘর। ভেতরে পাতা আছে বাঁশের বেঞ্চ। এখানে বসে দল বেঁধে গল্পে মশগুল নানা বয়সী মানুষ। উন্মুক্ত ঘরের ভেতরে ও আশপাশে লাল-নীল বৈদ্যুতিক আলোর রোশনাই। স্থানে স্থানে আছে গাছপালাও। তবে কিছুটা দূরে তাকালে চোখে পড়ে মিশমিশে অন্ধকার। পাশেই দৃষ্টিনন্দন ৯০০ ফুট দীর্ঘ ওয়াকওয়ে। সেখানেও আছে বসার পরিবেশ, আছে খাবারদাবারের অসংখ্য দোকান।

এ রকম এক দৃষ্টিনন্দন পরিবেশ দেখা গেছে সিলেট নগরের প্রাণকেন্দ্র জিন্দাবাজার এলাকার পাশের জল্লারপাড় ওয়াকওয়েতে। প্রতিদিন কয়েক হাজার মানুষ এখানে এসে আড্ডা দিচ্ছেন, খাচ্ছেন। অনেকে পরিবার-পরিজন নিয়েও রাতের সৌন্দর্য দেখতে আসছেন। কেউবা তুলছেন সেলফি। সিলেট শহরের এ যেন এক অন্য রূপ। দিবাগত রাত একটা থেকে দেড়টা পর্যন্ত এখানে ধুম আড্ডা চলে।

সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ২০১৪ সালে জল্লারপাড় এলাকায় জল্লার (জলাশয়) পাশে ছড়া (প্রাকৃতিক নালা) উদ্ধারের পর ২০১৭ সালে এখানে ওয়াকওয়ে নির্মাণে একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করে সিটি করপোরেশন। প্রায় ৫ কোটি টাকা ব্যয়ে এই প্রকল্পে দখল ও দূষণ ঠেকিয়ে ৯০০ ফুট দীর্ঘ একটি হাঁটার পথ তৈরি হয়েছে। এর সূত্র ধরে ছড়ার পাশে বেদখল হয়ে থাকা প্রায় ১০০ কোটি টাকা মূল্যের পাঁচ একর জল্লাশ্রেণির জায়গা সিটি মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীর নেতৃত্বে গত বছরের ২২ জুন পরিচালিত এক অভিযানে উদ্ধার করা হয়।

একই সূত্রে জানা গেছে, জল্লা উদ্ধার করে এখানে জমে থাকা দীর্ঘকালের বর্জ্য অপসারণ করা হয়। আগাছা সরিয়ে স্থানটিকে দৃষ্টিনন্দন হিসেবে তৈরি করে ফিরিয়ে আনা হয় এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। পরে জল্লাতে খড়ের ছাউনি দিয়ে ঘরের মতন দৃষ্টিনন্দন কিছু স্থাপনা তৈরি করা হয়। এর ঠিক পাশ ঘেঁষেই আছে ৯০০ ফুট দীর্ঘ ওয়াকওয়ে। পরে গত ফেব্রুয়ারি মাসে ওয়াকওয়ে ও এর আশপাশ ইজারা দেওয়া হয়।

সিটি কর্তৃপক্ষ আরও জানিয়েছে, ‘জল্লারপাড় ওয়াকওয়ে কমিটি কর্তৃপক্ষ’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান সিটি করপোরেশনের কাছ থেকে ২ লাখ ৮৫ হাজার টাকায় দেড় বছরের জন্য স্থানটি ইজারা নেয়। গত ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে ইজারা নেওয়া প্রতিষ্ঠানটি ওয়াকওয়ের এক পাশে ফুডকোর্ট চালু করে স্থানটি সবার চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়।

জল্লারপাড় ওয়াকওয়ে কমিটি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, পবিত্র রমজানের আগে প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত স্থানটি উন্মুক্ত থাকত। এখন ইফতারের পর প্রবেশের জন্য ফটক উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। রাত দেড়টা থেকে দুইটা পর্যন্ত মানুষ এখানে ভিড় করেন। প্রতিদিন তিন থেকে চার হাজার দর্শনার্থী এখানে আসেন। তবে ছুটির দিন শুক্র ও শনিবার এখানে পাঁচ থেকে সাত হাজার মানুষ আসেন। সিলেটে বাইরের অঞ্চলের যেসব পর্যটক আসেন, তাঁরাও এখানে এসে প্রাকৃতিক পরিবেশে বসে খাবারদাবারের পাশাপাশি আড্ডা জমাচ্ছেন।

সিলেট নগরের জল্লারপাড় ওয়াকওয়েতে প্রতিদিন রাতে ভিড় করেন হাজারো মানুষ। চলে আড্ডা আর খাওয়া–দাওয়া
ছবি: প্রথম আলো

ইজারা নেওয়া প্রতিষ্ঠানের পরিচালকদের একজন হচ্ছেন হুমায়ূন বকস। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, মানুষের হাঁটাচলার জন্যও সুপরিসর জায়গা রেখে ওয়াকওয়ে এলাকায় ২৩টি দোকানকোঠা তৈরি করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৮টি চালু আছে। ছয় মাস পরপর এসব দোকানমালিকে চুক্তি নবায়ন করতে হবে। রাতের খাবার, নাশতাসহ নানা ধরনের মুখরোচক খাবার এখানে মেলে। পাশাপাশি চা, কফি, শরবত ও পানের দোকান আছে।

গতকাল শুক্রবার রাত ৯টা থেকে ১১টা পর্যন্ত সরেজমিন দেখা গেছে, নানা বয়সী কয়েক শ মানুষের ভিড়ে মুখর ওয়াকওয়ে এলাকা। খড়ের ঘর, ওয়াকওয়েতে নির্মিত বেঞ্চ কিংবা রেস্তোরাঁয় বসে অনেকে খাওয়াদাওয়ার পাশাপাশি গল্প-আড্ডায় মেতে উঠেছেন। বয়স্ক থেকে তরুণ, সব বয়সীরাই এখানে আছেন। স্বামী, স্ত্রী ও সন্তান মিলে সপরিবারেও অনেকে এসেছেন।

রাত সোয়া নয়টার দিকে ওয়াকওয়েতে পাতা কয়েকটি টুলে বসে কয়েকজন তরুণকে আড্ডা দিতে দেখা যায়। শওকত হাসান, নাফিজ আহমদ ও শাহীনূর আলম নামের ওই তিন তরুণ জানান, তাঁরা সিলেটের একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। ওয়াকওয়েটি দৃষ্টিনন্দন হওয়ায় এখানেই তাঁরা নিয়মিত আড্ডা জমান। খেতে খেতে আড্ডা দেওয়ার এমন স্থান সিলেটে খুব একটা নেই। ফলে জায়গাটি ক্রমে নগরবাসীর পছন্দের এক আড্ডাস্থলে রূপ নিয়েছে।

‘চায়না টাউন’ নামের একটি রেস্তোরাঁয় বসে সপরিবারে বার্গার খাচ্ছিলেন শিবগঞ্জ এলাকার গৃহিণী রোকেয়া বেগম। তিনি জানান, ঈদের কেনাকাটা করতে বেরিয়েছেন। কেনাকাটার ফাঁকে এ দৃষ্টিনন্দন স্থানে স্বামী ও মেয়েকে নিয়ে একটু জিরিয়ে নিতে এসেছেন। সেই সঙ্গে হালকা নাশতাও করে নিচ্ছেন। আমেনা আক্তার নামের এক তরুণী বলেন, এখানে মশায় কামড়ায়। কোনো শৌচাগার নেই। এ দুই সমস্যা দূর হলে স্থানটি আরও আড্ডাবান্ধব হিসেবে খ্যাতি পাবে।

রাত পৌনে ১০টার দিকে ক্যাফে হাইড অ্যান্ড সেক নামের একটি রেস্তোরাঁর সামনে গিয়ে অনেক খাদ্যরসিকের ভিড় দেখা যায়। এ প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী রীনা আক্তার বলেন, তাঁর রেস্তোরাঁয় লুচির সঙ্গে বারবিকিউ চিকেন, চিকেন চাপ, চিকেন শিককাবাব, হাঁসের মাংস ভুনা, গরুর মাংস ভুনা, গরুর বট ভুনা, মুরগির কষা মাংস, মুরগির ঝুরি মাংস ভুনা, চাওমিন, পাস্তা, চিকেন নাচোস, ফ্রাইড চিকেন, ডাবের পুডিংসহ বিভিন্ন খাবার পাওয়া যায়। প্রতিদিন তাঁর রেস্তোরাঁয় শতাধিক মানুষ খাবার খেয়ে থাকেন বলে তিনি জানান।

ওয়াকওয়ে ইজারা নেওয়া প্রতিষ্ঠানের পরিচালকদের একজন শাহেদ আহমদ। তিনি বলেন, এখানে আগত ব্যক্তিদের নিরাপত্তার বিষয়টি দেখভাল করার জন্য ১৪টি সিসি ক্যামেরা বসানো হয়েছে। আছেন নিরাপত্তাপ্রহরীও। আড্ডাবান্ধব একটি স্থান তৈরি করতে তাঁরা চেষ্টা করছেন। দ্রুত এখানে শৌচাগার স্থাপনের পরিকল্পনা তাঁদের আছে।

সিলেট নগরের জল্লারপাড় ওয়াকওয়ে
ছবি: প্রথম আলো

সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী নূর আজিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, দীর্ঘদিন ধরে পরিত্যক্ত অবস্থায় থাকা জায়গাটির সৌন্দর্যবর্ধন করে তাঁরা নগরবাসীর বিনোদনের জন্য উপযোগী করে দিয়েছেন। পরে ২ লাখ ৮৫ হাজার টাকায় স্থানটি দেড় বছরের জন্য ইজারা দেওয়া হয়েছে। নগরবাসীর একটা দৃষ্টিনন্দন আড্ডার স্থান হয়েছে, এতে সিটি কর্তৃপক্ষও উচ্ছ্বসিত।