হাতকড়া পরাতে দেখেই চোখের জলে ছেলেদের ছাড়ালেন মা

পাঁচ ছেলের কেউ বৃদ্ধা মাকে খেতে দেন না। উল্টো বাবার রেখে যাওয়া জমি লিখিয়ে নিতে মাঝেমধ্যেই মারপিট করেন। এ ঘটনার বিচারের দাবিতে মা গিয়েছিলেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) দপ্তরে। এই খবর পেয়ে আরও ক্ষিপ্ত হয়ে ছেলেরা মাকে আরেক দফা মারপিট করে হাসপাতালে পাঠিয়েছিলেন। চার দিনের চিকিৎসা শেষে মা বিচারের আশায় যান একই কর্মকর্তার কার্যালয়ে। সবকিছু শুনে ছেলেদের পুলিশে দেওয়ার নির্দেশ দেন ইউএনও। পুলিশ যখন ছেলেদের হাতকড়া পরাতে শুরু করে, অভিযোগকারী মা কেঁদে তাঁদের ছেড়ে দেওয়ার অনুরোধ করেন।

সোমবার দুপুরে ঘটনাটি ঘটেছে মাগুরার শ্রীপুরের ইউএনওর কার্যালয়ে। সেখানে কান্নাজড়িত কণ্ঠে মা মোমেনা বেগম (৭৫) বলেন, ‘আমার মণিরা ভুল করেছে, আপনারা ক্ষমা করে দেন। আমার কোনো অভিযোগ নেই, আমি ছেলেদের হাজতবাস সহ্য করতে পারব না।’

মাগুরার শ্রীপুর উপজেলার হোগলডাঙা গ্রামের মৃত শফি উদ্দিন মোল্লার স্ত্রী মোমেনা বেগম। তাঁর পাঁচ ছেলে তিন মেয়ে। মেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন, ছেলেরাও বিয়ে করে পৃথক সংসার করছেন। মোমেনা বেগম জানান, তাঁর স্বামী শফি উদ্দিন চার বছর আগে মারা যান। স্বামীর মৃত্যুর পর থেকে ছেলেরা তাঁর খোঁজ নেন না। বড় ছেলে ইব্রাহিম খলিফা হোমিও চিকিৎসক। মেজ ছেলে আয়েব আলী কৃষিকাজ করেন। অন্য তিন ছেলে জাহিদুল ইসলাম, নুর ইসলাম ও সুরুজ আলী সবাই নানা ব্যবসা-বাণিজ্য করেন। সবাই সচ্ছল। তারপরও ছেলেরা তাঁকে খেতে-পরতে দেন না। স্বামীর রেখে যাওয়া জমি বর্গা দিয়ে আর মেয়েজামাইয়ের সাহায্যে চলে তাঁর খাওয়া-পরা।

মোমেনা জানান, তাঁর স্বামী মারা যাওয়ার সময় ১১০ শতাংশ চাষযোগ্য জমি রেখে গেছেন। যে জমি তিনি বর্গা দিয়ে রেখেছেন। সেখান থেকে যে টাকা পান, তা দিয়ে নিজের খাওয়া-পরা আর ওষুধ বাবদ খরচ করেন। কিন্তু ছেলেরা মাঝেমধ্যেই চাপ দেন এই জমি তাঁদের ভাগ করে দিতে। না দেওয়ায় মাঝেমধ্যেই তাঁকে মারপিট করেন ছেলেরা। চার বছর ধরে চলছিল ছেলেদের নির্যাতন। গত সপ্তাহে বিচার চাইতে শ্রীপুরের ইউএনওর কার্যালয়ে যান মোমেনা বেগম। অভিযোগ শুনে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছিলেন কর্মকর্তা। এই অবস্থায় বাড়ি ফেরার পর গত ৩০ আগস্ট তাঁকে আবারও মারপিট করেন ছেলেরা। ছেলেদের মার খেয়ে এবার তাঁকে ভর্তি হতে হয় মাগুরা ২৫০ শয্যা হাসপাতালে। চার দিন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে ২ সেপ্টেম্বর ছাড়পত্র পান তিনি।

মোমেনা বেগম জানান, হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র নিয়ে ওই দিন আবারও ইউএনওর কার্যালয়ে যান তিনি। অভিযোগ শুনে ছেলেদের ডেকে পাঠান ইউএনও লিউলা-উল জান্নাহ। সোমবার পাঁচ ছেলের মধ্যে চারজন সেখানে উপস্থিত হন। সবার কথা শুনে উপস্থিত কর্মকর্তা ছেলেদের পুলিশে দেওয়ার নির্দেশ দেন। উপস্থিত পুলিশ সদস্যরা ছেলেদের হাতে হাতকড়া দিতে শুরু করলে মা মোমেনা বেগমের খারাপ লাগে। কেঁদে ছেলেদের ছেড়ে দেওয়ার অনুরোধ করেন ওই নারী।

ইউএনও কার্যালয়ে উপস্থিত এক কর্মকর্তা জানান, ছেলেদের হাতে হাতকড়া পরাতে দেখে মোমেনা বেগম হাউমাউ করে কেঁদে ফেলেন। ছেলের হাতে হাতকড়া দেখে মায়ের আকুতি সবাইকে হতবাক করে দেয়। অবশ্য সেখানে উপস্থিত ছেলে ইব্রাহিম খলিফা, জাহিদ খলিফা ও নুর ইসলাম মাকে মারপিট করার কথা অস্বীকার করেন। তবে তাঁরা প্রতিশ্রুতি দেন, এখন থেকে তাঁরা মাকে দেখাশোনা করবেন।

জানতে চাইলে ইউএনও লিউলা-উল জান্নাহ বলেন, লিখিত অভিযোগের ভিত্তিতে মোমেনা বেগমের পাঁচ ছেলেকে উপস্থিত হতে বলা হয়েছিল। চার ছেলে উপস্থিত হন। মায়ের ভরণপোষণের জন্য ছেলেদের মাসে এক হাজার করে টাকা দিতে বলা হয়েছে। আর মাকে মারপিট করার অপরাধে তাঁদের নামে নিয়মিত মামলা নিয়ে কারাগারে পাঠানোর জন্য বলা হলেও পরে মায়ের কান্নাকাটিতে ছেলেদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।