হাসপাতাল রোগ সারায়, মনও জুড়ায়

পরিবর্তনের নেপথ্য কারিগর সাপাহার উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা চিকিৎসক মো. রুহুল আমিন।

  • স্বাভাবিক প্রসবে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে হাসপাতালটি। গত বছর ৫৫৪ জনের স্বাভাবিক প্রসব হয়েছে এখানে।

  • গত জানুয়ারিতে এই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সারা দেশে পঞ্চম, রাজশাহী বিভাগে প্রথম স্থান অধিকার করেছে।

কোনো পর্যটন বা বিনোদনকেন্দ্র নয়, এটি একটি হাসপাতাল চত্বরের ছবি। বাহারি ফুলে সাজানো-গোছানো, ঝকঝকে-তকতকে পরিবেশ। এখানকার সেবার মানও ভালো, রোগীরা সন্তুষ্ট। সম্প্রতি নওগাঁর সাপাহার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে
ছবি: প্রথম আলো

হাসপাতালের চত্বরজুড়ে বাহারি ফুল আর সবুজের সমারোহ। ঝকঝকে, তকতকে হাসপাতালটির ভেতরে বিভিন্ন ওয়ার্ডের সামনের বারান্দায় টবে ও গ্রিলে এবং ভবনের ছাদেও শোভা পাচ্ছে বাহারি ফুল, পাতাবাহার ও সৌন্দর্যবর্ধনকারী গাছ। হাসপাতাল চত্বরে মিনি শিশুপার্ক ও শিশু ওয়ার্ডের পাশে রয়েছে শিশুদের খেলার স্থান ‘কিডস জোন’। এ দৃশ্য নওগাঁর সাপাহার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের। হাসপাতালটিতে সেবা নিয়েও এলাকার মানুষ সন্তুষ্ট।

তবে সাপাহার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিত্র কিছুদিন আগেও এমন ছিল না। হাসপাতাল চত্বরে খোলা জায়গা পতিত পড়ে ছিল। ওই সব স্থান সারা বছর ময়লা-আবর্জনা ও কাদা-পানিতে ভরে থাকত। এখন হাসপাতলের পতিত জায়গাগুলো যেন হেসে উঠেছে। এ পরিবর্তনের নেপথ্য কারিগর সাপাহার উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা চিকিৎসক মো. রুহুল আমিন।

পরিবেশগত উন্নতি ছাড়াও স্বাস্থ্যসেবায়ও অনন্য অবদান রেখে চলেছে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি। সীমিত সামর্থ্যের মধ্যেই সেবার ক্ষেত্রেও যুগান্তকরী পরিবর্তন এসেছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মাসিক প্রতিবেদনে, স্বাস্থ্যব্যবস্থা শক্তিশালীকরণ (এইচএসএস) রেটিংসে গত জানুয়ারিতে সাপাহার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সারা দেশে পঞ্চম এবং রাজশাহী বিভাগে প্রথম স্থান অধিকার করেছে। স্বাভাবিক প্রসব, সিজারিয়ান অপারেশন, প্রসব–পূর্ব ও পরবর্তী সেবা, হাসপাতাল ব্যবস্থাপনাসহ অন্যান্য সেবা দেওয়ার জন্য এ রেটিং অর্জন করে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সারা দেশে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোকে বিভিন্ন ইনডিকেটর বা পরিমাপক দিয়ে পর্যালোচনা করে এ রেটিং করে।

সম্প্রতি হাসপাতালের প্রধান ফটক দিয়ে ঢুকতেই চোখ জুড়িয়ে গেল। জরুরি বিভাগের সামনেই গড়ে তোলা হয়েছে দৃষ্টিনন্দন থিমপার্ক। সেখানে বিভিন্ন ফুল, ঝাউ, পাতাবাহারসহ বাহারি সব গাছ শোভা পাচ্ছে। থিমপার্কে পরিত্যক্ত বোতল, গাড়ির টায়ারের নান্দনিক ব্যবহার বাগানের সৌন্দর্যকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। হাসপাতালের উত্তর দিকে দোলনায় চড়ে দোল খাচ্ছিল দুই শিশু। তার পাশেই কাঠ–খড় দিয়ে তৈরি দৃষ্টিনন্দন বিশ্রামাগার। সেখানে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগী ও তাঁদের স্বজনেরা বসে আছেন। ছাউনির পাশেই করা হয়েছে ভেষজ উদ্যান, যেখানে ৩৬ প্রকারের ঔষধি গাছ লাগানো হয়েছে। হাসপাতাল চত্বরের দক্ষিণ দিকে বহির্বিভাগে যাওয়ার রাস্তার দুই পাশে শোভা পাচ্ছে বাহারি ফুলের গাছ।

হাসপাতালে শিশুদের জন্য আছে পরিপাটি কিডস জোন
ছবি: প্রথম আলো

৫০ শয্যার হাসপাতালের মূল ভবনের ভেতরেও পরিচ্ছন্নতার ছাপ। পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, দিনে পাঁচ থেকে ছয়বার তাঁরা হাসপাতাল পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন করেন, শৌচাগারগুলো পরিচ্ছন্ন রাখেন।

হাসপাতালে দোতলায় ওঠার সিঁড়ির প্রতিটি ধাপ, দেয়াল ও করিডরে লেখা রয়েছে বিভিন্ন স্বাস্থ্যবার্তা। এ ছাড়া বিভিন্ন ওয়ার্ড ও কক্ষের দেয়াল এবং করিডরের দেয়ালে আলপনা আর প্রাসঙ্গিক চিত্রকর্ম পুরো হাসপাতালের পরিবেশকে করেছে দৃষ্টিনন্দন। হাসপাতালের দোতলায় শিশু ওয়ার্ডের সামনে একটি জায়গায় তৈরি করা হয়েছে কিডস জোন। সেখানে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন শিশু ছাড়াও রোগী ও তাঁদের স্বজনদের সঙ্গে আসা শিশুরা খেলাধুলা করে।

নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত চার বছরের শিশু জিয়াদকে নিয়ে হাসপাতালে এসেছেন পত্নীতলা উপজেলার দিবর গ্রামের বাসিন্দা নার্গিস আক্তার। তিনি বলেন, ‘বেশ কয়েক বছর আগে এ হাসপাতালে এসেছিলাম। তখন হাসপাতালের যেখানে-সেখানে অপরিষ্কার-অপরিচ্ছন্ন দেখেছিলাম। এবার এসে দেখি, সব ঝকঝকে, তকতকে। বাচ্চাটাকে নিয়ে কদিন ধরে এখানে আছি। যখন ও একটু ভালো থাকে, তখন কিডস জোনে গিয়ে খেলাধুলা করে। এ পরিবেশে থাকলে ছেলেটি দ্রুত সেরে যাবে।’

উপজেলার শিরন্টি এলাকা থেকে প্রসবজনিত ব্যথা নিয়ে গত ২৬ জানুয়ারি হাসপাতালে ভর্তি হন গৃহবধূ সাবিনা ইয়াসমিন (৩২)। গৃহবধূর স্বামী জিয়াউল হক বলেন, ‘এখানে আমার স্ত্রীর স্বাভাবিক প্রসব হয়েছে। বাচ্চা ও মা দুজনেই ভালো আছে।’

হাসপাতালটিতে কর্মরত স্বাস্থ্যকর্মীরা জানান, মাত্র তিন বছর আগেও জোড়াতালি দিয়ে চলছিল হাসপাতালটি। তবে এখন হাসপাতালের কর্মপরিবেশ সুন্দর হওয়ায় স্বাস্থ্যকর্মীদের কর্মস্পৃহা বেড়ে গেছে।

হাসপাতালের এ পরিবর্তন সম্পর্কে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা রুহুল আমিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে যখন আমি এখানে স্বাস্থ্য কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দিই, তখন থেকেই আমি ও আমার টিম তিনটি কর্মপরিকল্পনা ঠিক করি। সেগুলো হচ্ছে সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন কর্মপরিবেশ তৈরি, অচল, অর্ধসচল যন্ত্রপাতি ও লজিস্টিকসের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করা এবং মানসম্মত চিকিৎসাব্যবস্থা নিশ্চিত করতে আধুনিক সরঞ্জামের ব্যবহার।’

রুহুল আমিন আরও বলেন, ‘এ হাসপাতালে দীর্ঘদিন ধরে অস্ত্রোপচার কক্ষটি অচল হয়ে ছিল। এখন সেটি চালু করা হয়েছে। গত নভেম্বর থেকে এখানে প্রসূতি অস্ত্রোপচার করা হচ্ছে। করোনা মহামারি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়লে ২০২০ সালের শেষের দিকে উপজেলা পরিষদের অর্থায়নে হাসপাতালে সেন্ট্রাল অক্সিজেন সিস্টেম চালু করা হয়। সারা বাংলাদেশে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আমরাই প্রথম সেন্ট্রাল অক্সিজেন ব্যবস্থা চালু করি।’

নওগাঁর সিভিল সার্জন আবু হেনা মোহাম্মদ রায়নুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, সাপাহার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের পরিবর্তনের কথা জেনে ইতিমধ্যে জেলার অন্য স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোও পরিবর্তিত হতে শুরু করেছে। সদিচ্ছা ও সঠিক কর্মপরিকল্পনা থাকলে সীমিত সামর্থ্যের মধ্যেও ভালো কর্মপরিবেশ তৈরি ও সেবা দেওয়া সম্ভব।