নিজের প্রতিষ্ঠিত স্কুলের সামনে সোহেল রানা
ছবি: প্রথম আলো

কৈশোরে অসুখে পড়ে শারীরিক প্রতিবন্ধিতার শিকার হন সোহেল রানা (২৬)। এর পর থেকে চলাফেরা করতে হয় হুইলচেয়ারে। কিন্তু থেমে থাকেননি। প্রতিবন্ধী শিশু ও কিশোরদের লেখাপড়ার জন্য প্রতিষ্ঠা করেছেন স্কুল। বর্তমানে তাঁর স্কুলে শারীরিক, মানসিক, শ্রবণসহ বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধী ১৫০ জন শিশু-কিশোর পড়ালেখা করে।

সোহেল রানার বাড়ি নওগাঁর মান্দা উপজেলার কালিকাপুর ইউনিয়নের চকগৌরি গ্রামে। তাঁর স্কুলের নাম ‘আলোর সন্ধানে অটিস্টিক বুদ্ধি ও শারীরিক প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়’। ২০১৬ সালে প্রতিষ্ঠিত স্কুলটিতে অজ্ঞারজ্ঞান শেখানোর পাশাপাশি ডিজিটাল মাল্টিমিডিয়ার মাধ্যমে পাঠদান করা হয়। শারীরিক প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের করানো হয় ফিজিওথেরাপি ও ব্যায়াম।

সোহেল রানার স্কুলে কোনো বেতন-ভাতা ছাড়াই ছয় বছর ধরে নিয়োজিত আছেন সাতজন শিক্ষক। এ ছাড়া শিক্ষা সহকারী, কর্মচারী, নৈশপ্রহরীসহ আরও ১১ জন কাজ করেন। বেতন নেন না তাঁরাও। পর্যাপ্ত শ্রেণিকক্ষ ও শিক্ষক না থাকায় সপ্তাহে তিন দিন করে দুই শিফটে ক্লাস নেওয়া হয়। স্কুলে মাত্র একটি ভ্যানগাড়ি থাকায় দূরদূরান্ত থেকে প্রতিবন্ধী শিশু-কিশোরদের আসা-যাওয়া করতেও পড়তে হয় সমস্যায়।

স্কুলের প্রধান শিক্ষক গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘আমরা ১৮ জন শিক্ষক-কর্মচারী প্রায় ছয় বছর ধরে পারিশ্রমিক নিচ্ছি না। প্রতিবন্ধী মানুষের শিক্ষায় কাজ করাই বড় অনুপ্রেরণা প্রতিষ্ঠানের সভাপতি সোহেল রানার কাছে। তিনি শারীরিক প্রতিবন্ধী হওয়ার পরও এত কিছু করতে পারলে আমরা কেন পারব না—এই বোধ থেকে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছি।’

নিজের প্রতিষ্ঠিত স্কুলের বিষয়ে সোহেল রানা বলেন, ‘ছোটবেলায় নতুন বই হাতে পাওয়ার যে আনন্দের অনুভূতি, তা এখনো আমাকে তাড়িত করে। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলে পড়াশোনা করেছি। জটিল টাইফয়েডে ১৪ বছর বয়সে শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী হয়ে পড়ি। প্রতিবন্ধী কেউ লেখাপড়া করতে চান, কিন্তু সুযোগ পাচ্ছে না শুনলে নিজেকে স্থির রাখতে পারি না। এ জন্যই স্কুলটা করা। স্থানীয় সাংসদসহ বিভিন্ন ব্যক্তির সহযোগিতায় ইতিমধ্যে আধা পাকা দুটি শ্রেণিকক্ষ ও শিক্ষক-কর্মচারীদের জন্য একটি কক্ষ নির্মাণ করা হয়েছে। এ ছাড়া টিনের বেড়া ও ছাউনির দুটি শ্রেণিকক্ষ আছে।’

প্রতিষ্ঠানটি সরকারি হলে সুযোগ-সুবিধা বাড়ত এবং শিক্ষার মান আরও ভালো হতো বলে মনে করেন এই অদম্য তরুণ।

প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা আদায়েও ভূমিকা রাখছেন সোহেল রানা। এ জন্য ‘আলোর সন্ধ্যানে প্রতিবন্ধী উন্নয়ন সংস্থা’ নামে একটি সংগঠন গড়ে তুলেছেন তিনি। এর সদস্যসংখ্যা বর্তমানে ৫৫০।

সোহেল রানা বলেন, ‘মাত্র ৩০ জন প্রতিবন্ধী মানুষ নিয়ে ২০১৫ সালে এ সংস্থা প্রতিষ্ঠা করি। এর মাধ্যমে আমরা তাঁদের শিক্ষা ও অধিকার আদায়ে কাজ করে থাকি। তাঁদের সমাজের মূলধারায় নিয়ে আসতে চাই। বিভিন্ন সরকারি অফিস ও বেসরকারি সংস্থায় অনুরোধ করে এলাকার প্রতিবন্ধী মানুষজনের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা আদায় করে দিতে পেরেছি। প্রতিবন্ধীদের সহযোগিতা করতে আমার খুব ভালো লাগে।’

একসময় পরিবারের কাছে বোঝা ছিলেন সোহেল রানা। এখন সবাই তাঁকে নিয়ে গর্ব করেন। সোহেলের বাবা গুলবর রহমান বলেন, ‘১৯৯৫ সালে সোহেলের জন্ম। ছয় মাস বয়সে পোলিও টিকা নেওয়ার পর কঠিন টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়। এরপর সেরে উঠলেও পরে নানান শারীরিক জটিলতা দেখা দেয়। ১৪-১৫ বছর বয়সে একেবারেই চলার শক্তি হারিয়ে ফেলে। এখন আমার ছেলে যেভাবে প্রতিবন্ধী মানুষের অধিকার আদায় এবং শিক্ষার জন্য কাজ করে যাচ্ছে তাতে গর্ব হয়।’

নওগাঁর একটি বেসরকারি নার্সিং ইনস্টিটিউটের পরিচালক ও মান্দা উপজেলার কুশুম্বা এলাকার বাসিন্দা মুরাদ হাসান গত ডিসেম্বরে সোহেল রানার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঘুরে এসেছেন। তিনি বলেন, সোহেলের কর্মকাণ্ড দেখে তাঁর প্রতিষ্ঠানকে সহায়তা করার জন্য ঢাকার একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার সঙ্গে কথা বলেছেন। সংস্থাটি শিগগিরই ওই প্রতিষ্ঠানে সহায়তা করবে বলে আশ্বাস দিয়েছে।

জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের উপপরিচালক নূর মোহাম্মদ বলেন, সোহেল রানা অনন্য উদাহরণ। তিনি এলাকার সব প্রতিবন্ধী মানুষের খোঁজখবর রাখেন। প্রতিবন্ধীদের কার কী সরকারি সুযোগ-সুবিধা দরকার, সেসব বিষয়ে তিনি প্রায়ই সমাজসেবা অফিসে আবেদন নিয়ে আসেন। এখান থেকে তাঁকে যথাসাধ্য সহায়তা করার চেষ্টা করা হয়।