কুকুর, কাক, শালিকসহ পশুপাখিদের পরোটা খাওয়াচ্ছেন এক ব্যক্তি। এ সময় অভুক্ত কোনো মানুষ পেলে তাদেরও খেতে দিচ্ছেন পরোটা-সবজি। ঝালকাঠি শহরের কাপুড়িয়াপট্টির প্রতিদিন সকালের দৃশ্য এটি। ১২ বছর ধরে এভাবে পশুপাখি ও মানুষকে খাইয়ে দিনের শুরু করেন স্থানীয় অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষক নুরুল আমিন খলিফা (৬৫)। এলাকায় তিনি মানিক স্যার নামে পরিচিত।
এলাকাবাসী জানান, ফজরের নামাজ শেষে শহরের কাপুড়িয়াপট্টিতে আসেন নুরুল আমিন। এখান থেকে পশুপাখি ও মানুষকে পরোটা দিতে শুরু করেন তিনি। এরপর শহরের বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে পরোটা বিলি করেন। বেলা বাড়লে কয়েক ডজন টয়লেট টিস্যু কিনে একটি ইজিবাইকে চড়ে বিভিন্ন মসজিদের শৌচাগার ও অজুখানায় রেখে আসেন নুরুল আমিন। বৃহস্পতিবার সাপ্তাহিক হাটের দিন নিজেদের কাপড়ের দোকানে বসে শতাধিক ভিক্ষুককে খাওয়ান কলা-রুটি। তাদের মধ্যে ২০ জনের জন্য দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করেন। এ ছাড়া শহরের ফরিয়াপট্টির ডাকঘাটা বাসন্ডা খালপাড় ও নতুন কবরস্থান এলাকায় রোপণ করেছেন শতাধিক ফলের গাছ।
আড়তদারপট্টি এলাকার রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ী শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘স্যার প্রতিদিন সকাল হলেই আমার রেস্তোরাঁ থেকে ২০০ টাকার পরোটা কেনেন। এরপর পশুপাখি ও মানুষকে খাওয়ান। তাঁর মনে মানুষ ও পশুপাখির জন্য অনেক মায়া। ২০১৭ সালে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মানবিক সাহায্য দিতে টেকনাফে গিয়ে ১২ দিন ছিলেন তিনি। সেখানে একটি হোটেলে অবস্থান করে প্রতিদিন দুই শতাধিক রোহিঙ্গা শরণার্থীকে শুকনা খাবার দিয়েছেন।’
নুরুল আমিন খলিফা ঝালকাঠি শহরের কাপুড়িয়াপট্টি এলাকার মৃত রফিজ উদ্দিন খলিফার ছেলে। ঝালকাঠি শহরে তাঁদের পৈতৃক কাপড়ের ব্যবসা রয়েছে। স্থানীয় কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নুরুল আমিন কাঠপট্টি এলাকার কালিতারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক। ’৯০–এর দশকে এক হিন্দু ব্যক্তির কাছ থেকে জমি নিয়ে বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর বিদ্যালয়টি জাতীয়করণসহ অবকাঠামো নির্মাণে বাবার কাপড়ের ব্যবসার লাভের একটা বড় অংশ খরচ করেন। বাড়ি বাড়ি গিয়ে অভিভাবকদের বুঝিয়ে শিক্ষার্থী ভর্তি করিয়েছেন। বিদ্যালয়ের আঙিনায় লাগিয়েছেন নানা রকম ফলের গাছ। তাঁর হাতে গড়া বিদ্যালয়টি ২০১৩ সালে জাতীয়করণ হয়। কিন্তু এর আগেই ২০১০ সালে অবসরে যান নুরুল আমিন।
ফরিয়াপট্টি ডাকঘাটা এলাকার রুস্তম আলী বলেন, ‘মানিক স্যার অবসরের যাওয়ার পর থেকে নদীর পাড়ে ফলের গাছ লাগাতে শুরু করেন। গত বছর বাসন্ডা খালপাড়ে তাঁর লাগানো গাছে প্রায় ৩০ মণ আমড়া ধরেছে। আমরা বিভিন্ন সময় তাঁর লাগানো গাছ থেকে ফল পেড়ে খাই।’
মৃত্যুর আগপর্যন্ত মানুষ ও পশুপাখির জন্য কাজ করে যেতে চান নুরুল আমিন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার জীবনের শেষ সম্বলটুকু পশুপাখি ও মানুষের কল্যাণে বিলিয়ে দিতে চাই। পরিবারের সদস্যরাও আমার ভালো কাজে সহায়তা করে।’
নুরুল আমিন দুই সন্তানের জনক। তাঁর ছেলে মুফতি মাহমুদ বাবার এসব কাজে গর্ববোধ করেন। তিনি বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি আব্বা অন্যের উপকার করতে ভালোবাসেন। পশুপাখির জন্যও তাঁর অনেক দরদ।’
প্রথম আলোর ২৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে গত ৯ নভেম্বর ঝালকাঠি প্রেসক্লাব মিলনায়তনে নুরুল আমিনকে আলোকিত মানুষ হিসেবে সম্মাননা স্মারক দেওয়া হয়। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন জেলা প্রশাসক মো. জোহর আলী। জেলা প্রশাসক বলেন, নুরুল আমিন একজন মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ। তাঁদের মতো আলোকিত মানুষ সমাজে আরও প্রয়োজন।