নেত্রকোনা জেলা প্রশাসনের বিভিন্ন শাখায় কর্মকর্তা-কর্মচারী মিলে অন্তত ৩৪২টি পদ শূন্য রয়েছে। পদগুলো শূন্য থাকায় একজন কর্মকর্তাকে নিজ দাপ্তরিক কাজের পাশাপাশি অন্য দপ্তরের অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে। এতে দাপ্তরিক কাজ ব্যাহত হওয়ায় স্থানীয় লোকজন প্রয়োজনীয় সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
জেলা প্রশাসকের কার্যালয় ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, জেলা প্রশাসনের অধীন ২২টি শাখায় কর্মকর্তা ও কর্মচারী মোট ৯০৭ জন। এর মধ্যে রাজস্ব প্রশাসনে ৫২০টি পদ রয়েছে। অন্য পদগুলো সংস্থাপন (সাধারণ) প্রশাসনে। এই পদগুলোর মধ্যে প্রথম শ্রেণির (ক্যাডার) পদে ৪২ জনের জায়গায় ৩৩ জন কর্মরত আছেন। এর মধ্যে পাঁচটি অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকের (এডিসি) পদের মধ্যে দুটি পদ শূন্য।
জেলা প্রশাসকের কাযালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘এ’ ক্যাটাগরির জেলা ঘোষণা হওয়ার পর প্রায় ৩৭ বছর চলে গেলেও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা) ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (মানবসম্পদ উন্নয়ন) পদ দুটিতে এখন পর্যন্ত কোনো লোক নিয়োগ করা সম্ভব হচ্ছে না।
অন্যদিকে নেজারত ডেপুটি কালেক্টর (এনডিসি), জেনারেল সার্টিফিকেট অফিসার (জেসিও), ভূমি হুকুম দখল কর্মকর্তা (এলএও), সহকারী পরিচালক স্থানীয় সরকার (এডিএলজি), সহকারী কমিশনার ভূমি (এসি ল্যান্ড) ও সহকারী কমিশনারের একটি করে পদ শূন্য পড়ে আছে।
জেলা প্রশাসনের ১০টি সহকারী কমিশনারের পদের মধ্যে যে ৯ জন আছেন, তাঁদের মধ্যে ৪ জন শিক্ষানবিশ সহকারী কমিশনার গত ২২ আগস্ট থেকে ৫ মাসের জন্য বনিয়াদি প্রশিক্ষণে রয়েছেন। জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘এ’ ক্যাটাগরির জেলা ঘোষণা হওয়ার পর প্রায় ৩৭ বছর চলে গেলেও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা) ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (মানবসম্পদ উন্নয়ন) পদ দুটিতে এখন পর্যন্ত কোনো লোক নিয়োগ করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসককে (রাজস্ব) নিজ দপ্তরের পাশাপাশি ওই দুটি দপ্তরের অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে।
এদিকে এনডিসি, জেসিও, এলএও, এডিএলজি উচ্চ (সিনিয়র) স্কেলের এই পদগুলো প্রায় ১ থেকে ১২ বছর ধরে শূন্য আছে। ভারপ্রাপ্ত দিয়ে তা চালাতে হচ্ছে। জেলার কেন্দুয়া উপজেলায় সহকারী কমিশনার (ভূমি) পদটি গত ১৬ আগস্ট থেকে খালি থাকায় সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছেন।
এ ছাড়া ১১টি প্রশাসনিক কর্মকর্তার মধ্যে ৬টি, একটি করে থাকা অতিরিক্ত ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা, সহকারী প্রকৌশলী, উপসহকারী প্রকৌশলী, পরিসংখ্যান সহকারী, ১২টি কানুনগোর পদের মধ্যে ১১টি, ১০টি অফিস সুপারের পদের মধ্যে ৫টি, ১০টি সিএ কাম ইউডিএ পদের মধ্যে ৭টি, ১২টি সাঁট মুদ্রাক্ষরিক কাম কম্পিউটার অপারেটর পদের মধ্যে ৫টি, ১৮টি সার্ভেয়ারের মধ্যে ৫টি, ৮৬টি ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তার পদের মধ্যে ৩৫টি, ৮৬টি ইউনিয়ন ভূমি উপসহকারী কর্মকর্তার মধ্যে ৪১টি, ১০টি করে থাকা সার্টিফিকেট পেশকার, সার্টিফিকেট সহকারী, নাজির কাম ক্যাশিয়ার, ক্রেডিট চেকিং কাম সায়রাত সহকারী, অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক, নামজারি সহকারী, ২১টি প্রসেস সার্ভার (জারিকারক), ৭৪টি অফিস সহায়ক, ১৪টি চেইনম্যান, ৫টি ফটোকপি অপারেটর, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, নিরাপত্তাপ্রহরী, ট্রেসার, কার্য সহকারীসহ রাজস্ব ও সাধারণ শাখার ৩৩৩টি বিভিন্ন পদ দীর্ঘদিন ধরে শূন্য রয়েছে।
একজন কর্মকর্তাকে নিজ শাখার কাজের পাশাপাশি অন্যান্য শাখায় অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ, ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা, বোর্ড পরীক্ষা পরিচালনা, বিভিন্ন সভা-সেমিনারে অংশগ্রহণসহ অন্যান্য কাজ জোড়াতালি দিয়ে চালাতে হচ্ছে।মোহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মাহমুদ, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক)
কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংকটের কারণে যাঁরা কর্মরত আছেন, নিজ দায়িত্বের পাশাপাশি তাঁরা অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকা এক কর্মকর্তা বলেন, গুরুত্বপূর্ণ কিছু পদ শূন্য থাকায় রাজস্ব আদায়, স্থানীয় সরকারসহ বিভিন্ন দপ্তরের কার্যক্রম দেখভাল ও অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণসহ নানা প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনায় বেগ পোহাতে হচ্ছে। অতিরিক্তি দায়িত্বের চাপে ভারপ্রাপ্তরাও অনেক সময় সঠিক সিন্ধান্ত নিতে পারছেন না। এ কারণে যথাসময়ে কাজও সম্পন্ন হচ্ছে না।
এদিকে লোকবলসংকটের কারণে কাঙ্খিত নাগরিকসেবা না পাওয়ার অভিযোগ করছেন সাধারণ মানুষ। কেন্দুয়া পৌর শহরের চকপাড়া এলাকার সেলু মিয়া বলেন, ‘জমিসংক্রান্ত কাজে উপজেলা ভূমি অফিসে আসছিলাম। কিন্তু এসি ল্যান্ড না থাকায় কাজটি কোনো সুরাহা করা যাচ্ছে না।’
নেত্রকোনা সদর উপজেলার রায়দুমরুহি গ্রামের নুরুল ইসলাম ও তপন দেবনাথ জানান, শেখ হাসিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের জমি অধিগ্রহণসংক্রান্ত কাজে তাঁরা দীর্ঘদিন ধরে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে ধরণা দিলেও কোনো সমাধান হচ্ছে না।
বিষয়টি বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়সহ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়েছে। কিছু পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিও প্রকাশ করা হয়েছে। আশা করা হচ্ছে দ্রুত এটির সমাধান মিলবে।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) নেত্রকোনা কমিটির সভাপতি শ্যামলেন্দু পাল অভিযোগ করে বলেন, জেলা প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ এসব পদ দীর্ঘদিন ধরে শূন্য থাকায় জনগণ প্রশাসনের কাছ থেকে আশানুরূপ সেবা পাচ্ছেন না। ঊধ্বর্তন কর্তৃপক্ষের এ বিষয়ে দ্রুত নজর দেওয়া প্রয়োজন।
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মোহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, পদগুলো শূন্য থাকায় একজন কর্মকর্তাকে নিজ শাখার কাজের পাশাপাশি অন্যান্য শাখায় অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ, ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা, বোর্ড পরীক্ষা পরিচালনা, বিভিন্ন সভা-সেমিনারে অংশগ্রহণসহ অন্যান্য কাজ জোড়াতালি দিয়ে চালাতে হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে জেলা প্রশাসক কাজি মো. আবদুর রহমান বলেন, প্রশাসনে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের গুরুত্বপূর্ণ এই পদগুলো শূন্য থাকায় অনেক ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে। বিষয়টি বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়সহ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়েছে। কিছু পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিও প্রকাশ করা হয়েছে। আশা করা হচ্ছে দ্রুত এটির সমাধান মিলবে।