ভরদুপুরের প্রখর রোদে মো. মজিবর রহমানের শরীর বেয়ে ঘাম ঝরছে। কাঁধে মাটির ঝুড়ি। তাই জিরিয়ে নেওয়ার ফুসরত নেই। মজিবরের বয়স ৭৭ ছুঁই ছুঁই। তবে জাতীয় পরিচয়পত্রে বয়স কম হওয়ায় তিনি বয়স্কভাতার কার্ড পাননি। নীলফামারী জেলা সদরের ইটাখোলো ইউনিয়নের চৌধুরীপাড়া গ্রামে দেখা হয় মজিবর রহমানের সঙ্গে। বয়সের ভারে নুয়ে পড়া মজিবর তখন কাঁধে করে মাটির ঝুড়ি এনে সড়কের পাশে ফেলছিলেন।
চৌধুরীপাড়া গ্রামের মজিবরের বাড়ি। স্ত্রী মর্জিনা বেগমকে (৬৫) নিয়ে তাঁর সংসার। একমাত্র মেয়ের বিয়ে হয়েছে প্রায় ১৫ বছর আগে। কোনো ছেলে নেই। স্ত্রীর ডান পা ফোলা থাকায় তিনি কোনো কাজকর্ম করতে পারেন না। এ কারণে পরিবারের দায়িত্ব তাঁকেই পালন করতে হয়। তাঁর পৌনে দুই শতাংশ ভিটাটুকুই সব সম্বল।
সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও প্রতিবছর ১ মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস হিসেবে পালন করা হলেও মজিবরের মতো দিনমজুরেরা অবহেলিত থাকছেন। বছরের পর বছর হাড়ভাঙা খাটুনির পরও তাঁদের ভাগ্য বদল হয় না। তাই তাঁদের ঈদ আনন্দ উদ্যাপনের জন্য অন্যের দানের ওপর নির্ভর করতে হয়।
ঈদে কী কিনেছেন, তা জানতে চাইলে মজিবর বলেন, ‘কাপড় কিনিম কী দিয়া! আইজ ৩০ থাকি ৩৫ বছর বউক নয়া কাপড় দিবার পারো নাই। জাকাতের কাপড় দিয়ায় চলেছে। বিয়ার পর প্রত্যেক ঈদোতে বউক নয়া নয়া কাপড়-জামা কিনি দিছু। তখন মোর বয়স কম ছিল, কাম কামাই ভালো ছিল।’
এক দিন কাজ করলে পরের দুই দিন অসুস্থ থাকেন মজিবর। তখন সংসারে অনটন শুরু হয়। বয়স বেশি হওয়ায় অনেকে কাজেও নিতে চান না। কাজ কম করলে মজুরি কম দেওয়ার ভয়ে তিনি টানা কাজ করেন। শুধু খাওয়ার সময়টুকু জিরিয়ে নেন।
মজিবর রহমান বলেন, ‘গরমে শরীল (শরীর) চলে না, তারপরও কাম না কইরলে খামো কী! যেদিন কাম করির পারো না, সেদিন ধারকর্জ করি খাবার নাগে। বয়স্ক ভাতার কার্ড হছিলো, এক বছর খাইছি, পরে ভোটার আইডি কার্ডের হিসাবে সেখান বাতিল হইছে। জন্মনিবন্ধনত মোর বয়স ৭৭ বছর, আর আইডি কাডত বলে কম।’
প্রতিবেশী মো. আলম হোসেনের বাড়ির সামনে রাস্তার পাশে মাটি ফেলার কাজ করছিলেন। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করে মজুরি পাবেন ৩৫০ টাকা। আলম হোসেন বলেন, ‘আমার বাড়ির সামনে পাকা রাস্তার ধার দিয়ে মাটি ফেলার জন্য মজিবর রহমানকে কাজে লাগিয়েছি। ওনার বয়স বেশি বলে দ্রুত কাজ করতে পারেন না। এ জন্য কেউ কাজেও নিতে চান না। আমি তাঁকে ৩৫০ টাকা দিন হাজিরায় কাজ করাচ্ছি। সকাল সাতটা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত কাজ করবেন তিনি।’
জন্মতারিখের জটিলতার কারণে বয়স্কভাতার কার্ড পাননি মজিবর রহমান। তাঁর জন্মনিবন্ধনে দেখা যায়, জন্মতারিখ ৪ অক্টোবর, ১৯৪৫। ওই হিসাবে তাঁর বয়স প্রায় ৭৭ বছর। আবার জাতীয় পরিচয়পত্রে জন্মতারিখ লেখা আছে ৮ অক্টোবর, ১৯৫৭।
এ বিষয়ে কথা বললে ইটাখোলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. হেদায়েত আলী শাহ ফকির বলেন, ‘বিষয়টি আমার জানা ছিল না। ঈদের পর আমি বিষয়টি দেখে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দেব।’