৪৭ বছর স্কুলের ঘণ্টা বাজিয়েছেন, আজ বাজালেন শেষ ঘণ্টা
মাত্র ১৩ বছর বয়সে বিদ্যালয়টিতে দপ্তরি হিসেবে চাকরি শুরু করেছিলেন ইউনুচ আলী (৬০)। ৪৭ বছর সেখানে ঘণ্টা বাজিয়েছেন, আজ মঙ্গলবার বাজালেন শেষ ঘণ্টা। ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর উপজেলার জালালপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের চাকরি থেকে অবসরে গেলেন তিনি।
প্রায় চার যুগ একই প্রতিষ্ঠানে চাকরি। আজ শেষ দিনে ইউনুচ আলীর মনে ভাসছিল কত কত স্মৃতি। বিদায়বেলাতে অঝোরে চোখের পানি ফেলে বললেন, জীবনের সব স্মৃতিই এই বিদ্যালয়কে ঘিরে। বিদ্যালয়কে এতটা ভালোবেসে দায়িত্ব পালন করে গেছেন, কখনো একটা কারণ দর্শানো নোটিশ (শোকজ) তাঁকে দেওয়া হয়নি। বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা ছিলেন তাঁর অভিভাবক আর শিক্ষার্থীরা ছিল সন্তান। আজ সব ছেড়ে চলে যেতে হচ্ছে। বাকি জীবনটা কীভাবে কাটবে, সেটা ভাবতেই চোখে পানি চলে আসছে তাঁর।
ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর উপজেলার কুশনা ইউনিয়নের একটি গ্রাম জালালপুর। এই গ্রামের শিক্ষানুরাগী লোকজন ১৯৬৮ সালে প্রতিষ্ঠা করেন এই মাধ্যমিক বিদ্যালয়। সদ্য প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়টি তখন ছিল বেড়ার ঘর। ১৯৮০ সালের পর এখানে পাকা ভবন নির্মাণ করা হয়। সেই সময় ইউনুচ আলী নির্মাণকাজ দেখাশোনা করতেন। নিজেও মাথায় করে ইট টেনেছেন। এভাবে প্রতিষ্ঠানটিকে নিজের করে নিয়েছেন। বিদ্যালয়টি ১৯৮৫ সালের ১ সেপ্টেম্বর এমপিওভুক্ত হয়। আজ সেখানে নতুন নতুন ভবন রয়েছে, ১৫ জন শিক্ষক-কর্মচারী চাকরি করছেন।
প্রায় চার যুগ একই প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেছেন ইউনুচ আলী। প্রথম চাকরিতে যোগদানের পর প্রতিষ্ঠান ৩০ টাকা করে দিত, সরকার থেকে পেতেন ৫০ টাকা। প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত হওয়ার পর পেতেন ১২০ টাকা। বর্তমানে ১০ হাজার ৩৫০ টাকা বেতন পেয়ে তিনি অবসরে গেলেন।
ইউনুচ আলী ঝিনাইদহের হরিণাকুণ্ডু উপজেলার শাখারীদহ গ্রামের মৃত ইয়ার আলী মণ্ডলের ছেলে। পরিবারে তাঁর স্ত্রী, তিন মেয়ে ও এক ছেলে রয়েছে। ইউনুচ আলী বলেন, জালালপুর গ্রামে তাঁর মামার বাড়ি। তাঁর বয়স যখন মাত্র ১৩ বছর, তখন মামা নূর আলী মণ্ডল ডেকে পাঠান। মামার বাড়িতে আসার পর মামা জালালপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে দপ্তরি হিসেবে চাকরিতে ঢুকিয়ে দেন। সেই থেকে এই প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেছেন। পৈতৃক বাড়ি অন্য উপজেলায় হওয়ায় এখানে এসে মামার বাড়িতে থাকতেন। কিন্তু স্কুলকে ভালোবেসে স্কুলের জমির পাশেই পরে জমি কিনে বাড়ি করেছেন। রাতদিন প্রতিষ্ঠানটি আগলে রেখেছিলেন।
ইউনুচ আলী বলেন, বিদ্যালয়ের দপ্তরির চাকরি করেই ৩০ শতক জমি কিনে সেখানে ফ্ল্যাট বাড়ি করেছেন। মাঠে তিন বিঘা চাষযোগ্য জমি কিনেছেন। এ ছাড়া ছেলেমেয়েদের পড়ালেখা করাচ্ছেন। বড় মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। দ্বিতীয় মেয়ে অনার্স পড়ছেন। ছেলে উচ্চমাধ্যমিক দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। সবার ছোট মেয়ে এই বিদ্যালয়েই অষ্টম শ্রেণিতে পড়ছে। সেই সময়ের কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, প্রথম চাকরিতে যোগদানের পর প্রতিষ্ঠান ৩০ টাকা করে দিত, সরকার থেকে পেতেন ৫০ টাকা। প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত হওয়ার পর পেতেন ১২০ টাকা। বর্তমানে ১০ হাজার ৩৫০ টাকা বেতন পেয়ে তিনি অবসরে গেলেন।
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোছা. আক্তার জাহান বলেন, ইউনুচ আলী সদা হাসিখুশি মানুষ। সব শিক্ষকের সঙ্গে তাঁর ভালো সম্পর্ক ছিল। তিনিই এই প্রতিষ্ঠানে সবচেয়ে বেশি দিন চাকরি করেছেন। এ কারণে বিদ্যালয়ের সবকিছুই তাঁর জানা ছিল। কারও বিপদ-আপদে তাঁর তুলনা ছিল না। প্রধান শিক্ষক বলেন, শেষ দিনে ইউনুচ আলী শেষ ঘণ্টাটি বাজানোর পর তাঁরা ফুল ও কিছু উপহারসামগ্রী দিয়ে তাঁকে বিদায় জানিয়েছেন।