জেলা সমাজসেবা অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, বগুড়ার ১২ উপজেলায় ভিক্ষুকের সংখ্যা ৩ হাজার ৯১৫। এর মধ্যে অক্ষম ভিক্ষুকের সংখ্যা ১ হাজার ১৩৫ এবং শারীরিক প্রতিবন্ধী ভিক্ষুকের সংখ্যা ৬৫৮। নতুন করে ২৯ জন অসহায় ভিক্ষুককে পুনর্বাসিত করতে প্রত্যেককে ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এই অর্থে দোকানঘর নির্মাণ করে দিয়ে মালামাল কিনে দেওয়া হয়েছে।
জেলা সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপপরিচালক আবু সাঈদ মো. কাওছার রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ২০১০ সাল থেকে জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় সরকারের ভিক্ষুক পুনর্বাসন কার্যক্রম শুরু হয়। এ উদ্যোগ বাস্তবায়নে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে ‘ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োজিত জনগোষ্ঠীর পুনর্বাসন ও বিকল্প কর্মসংস্থান’ শীর্ষক কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দেশের ৫৮টি জেলায় ভিক্ষুক পুনর্বাসনে বিশেষ বরাদ্দ দেওয়া হয়। এ কর্মসূচির আওতায় এ পর্যন্ত বগুড়া জেলায় ৩৮১ জন ভিক্ষুককে পুনর্বাসন করা হয়েছে।
মেয়েডাক বিয়া দেওয়া লাগবি। অন্ধ মানুষ। ঠিকমতো ভিক্ষা জুটাপার পারি না। বউ-ছলের প্যাটত ভাতও জুটাপার পারি না। দোকানডা পায়্যা খুব ভালো হলো। আর ভিক্ষা করমো না। ব্যবসা করেই প্যাটত ভাত জোটামো।
গাবতলী উপজেলার প্রথমার ছেও গ্রামের ইসমাইল হোসেনের বয়স প্রায় ৭০ বছর। জন্মান্ধ ইসমাইল একসময় বগুড়ায় পরিবহনশ্রমিক হিসেবে পূর্ব বগুড়া বাসস্ট্যান্ডে কাজ করে জীবিকা চালাতেন। ১৭ বছর আগে কাজ হারিয়ে দিশাহারা হয়ে পড়েন। সংসারে স্ত্রী নুরজাহান ছাড়াও চার ছেলেমেয়ে আছেন। বাধ্য হয়ে স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে ভিক্ষাবৃত্তি শুরু করেন ইসমাইল। এখন বিয়ের বয়সী এক মেয়ে আছেন। সংসারের খরচও বেড়েছে। ভিক্ষার উপার্জনে ঠিকমতো ভাত জোটে না।
ইসমাইল বলেন, ‘মেয়েডাক (মেয়েটা) বিয়া দেওয়া লাগবি। অন্ধ মানুষ। ঠিকমতো ভিক্ষা জুটাপার পারি না। বউ-ছলের প্যাটত ভাতও জুটাপার পারি না। দোকানডা পায়্যা খুব ভালো হলো। আর ভিক্ষা করমো না। ব্যবসা করেই প্যাটত ভাত জোটামো।’ নুরজাহান বলেন, ‘অন্ধ সোয়ামির সঙ্গে রোদত পুড়ে, বৃষ্টিত ভিজে রাস্তাত ভিক্ষা করতে কষ্ট হচ্চিল। দোকানডা পায়্যা কষ্টের শ্যাষ হলো।’
বগুড়ার ১২ উপজেলায় ভিক্ষুকের সংখ্যা ৩ হাজার ৯১৫। এর মধ্যে অক্ষম ভিক্ষুকের সংখ্যা ১ হাজার ১৩৫ এবং শারীরিক প্রতিবন্ধী ভিক্ষুকের সংখ্যা ৬৫৮। নতুন করে ২৯ জন অসহায় ভিক্ষুককে পুনর্বাসিত করতে প্রত্যেককে ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
১৪ বছর আগে ভ্যানচালক স্বামী বাচ্চু মিয়া মারা যাওয়ার পর বগুড়া সদরের সরলপুর গ্রামের আমেদা বেওয়া (৬৫) ভিক্ষাবৃত্তি শুরু করেন। ভিক্ষার উপার্জনেই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। একমাত্র ছেলে বিয়ে করে আলাদা সংসার করছেন। দোকান পেয়ে ভিক্ষা ছেড়ে নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখছেন আমেদা।
জেলা প্রশাসক মো. জিয়াউল হক বলেন, ভিক্ষাবৃত্তিকে নিরুৎসাহিত করে ভিক্ষুকদের স্বনির্ভর করতেই পুনর্বাসনের এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এই উদ্যোগের মাধ্যমে বগুড়াকে ভিক্ষুকমুক্ত করার সরকারের মহৎ উদ্যোগ সফল হবে।
গাবতলীর বেতুয়ারকান্দি গ্রামের শ্রবণপ্রতিবন্ধী পল্টু মিয়া ভিক্ষা করে জীবিকা চালান। সংসারে স্ত্রী ছাড়াও দুই সন্তান তাঁর। বড় ছেলে জাহানুর আলম গাবতলী উপজেলার দুর্গাহাটা উচ্চবিদ্যালয় থেকে এবার এসএসসি পরীক্ষার্থী। বাবার সঙ্গে জাহানুরও এসেছিল জেলা প্রশাসন চত্বরে দোকানঘর উপহার নিতে। জাহানুর বলে, চারজনের সংসার। বৃদ্ধ বাবা ঠিকমতো ভিক্ষাও করতে পারেন না। প্রায় দিনই অনাহারে থাকতে হয়।’
বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার যমুনার দুর্গম বেনুপুর চরে বসতঘর ছিল দিনমজুর মেহেদী হাসানের (৪০)। যমুনার ভাঙনে বসতঘর বিলীন হওয়ার পর ঠাঁই নেন খোর্দ্দ বলাইল বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে। ১০ বছর ধরে ভিক্ষা করে জীবিকা চলে তাঁর। মেহেদী বলেন, দোকানঘরের চাবির সঙ্গে ৯২ ধরনের মনিহারি পণ্য উপহার পেয়েছেন। ভিক্ষা ছেড়ে স্বনির্ভর হতে পারবেন, সেটা ভেবেই ভালো লাগছে।