'সাহিত্যের আরও বেশি উদ্যাপন দরকার'

বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে ঢাকা লিট ফেস্ট–এর প্রথম দিনে মূল বক্তব্য দেন ভারতীয় লেখক নয়নতারা সেহগাল l প্রথম আলো
বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে ঢাকা লিট ফেস্ট–এর প্রথম দিনে মূল বক্তব্য দেন ভারতীয় লেখক নয়নতারা সেহগাল l প্রথম আলো

বাড়তি নিরাপত্তার কারণে গতকাল বৃহস্পতিবার ‘ঢাকা লিট ফেস্ট’-এর প্রথম দিন সকালে বাংলা একাডেমি চত্বরে তেমন দর্শক ছিল না। কিন্তু আয়োজনের ‘মূল মঞ্চ’-এর মিলনায়তনে দেখা গেল অনেক দর্শক। উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তারা সবাই এসেছে নয়নতারা সেহগালের বক্তৃতা শুনতে।
প্রখ্যাত লেখক নয়নতারা সেহগাল ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর বোন, বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিতের মেয়ে। ১৯৮৬ সালে রিচ লাইক আস উপন্যাসের জন্য তিনি সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার পেয়েছিলেন। সম্প্রতি ভারতজুড়ে বাড়তে থাকা অসহিষ্ণুতার প্রতিবাদে তিনি রাষ্ট্রীয় পুরস্কারটি ফিরিয়ে দিয়েছেন।
নয়নতারা তাঁর বক্তৃতার শুরুতেই জানিয়ে দিলেন, বিশ্বজুড়ে এখন যে অস্থিরতা চলছে, তার মধ্যে সাহিত্য নিয়ে সুন্দর সুন্দর কথা বলতে তিনি এখানে আসেননি। তিনি বলতে এসেছেন তাঁর নিজের দেশ ভারতে কী হচ্ছে সেসব। বহু ধর্ম ও বহু সংস্কৃতির মানুষের ভারতে বহুমত প্রকাশ করার সাংবিধানিক অধিকার আছে। কিন্তু এখন সেখানে ভিন্নমতের প্রতি অসহিষ্ণুতা দেখা যাচ্ছে। তিনি বলেন, এখন কিছু করার সময়। ভারতের সাহিত্যিক, সাংবাদিক, শিল্পী, বৈজ্ঞানিক সবাই প্রতিবাদ করছেন। এটা কোনো পরিকল্পিত আন্দোলন নয়, বরং স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ। ব্যক্তির অধিকার আছে যেকোনো ধর্ম পালন করার। রাষ্ট্রের কোনো ধর্ম নেই। তাই ভারত বা তার সরকার নাগরিকদের ওপর হিন্দুত্ব চাপিয়ে দিতে পারে না। প্রশ্ন আসতে পারে, এসবের সঙ্গে সাহিত্যের কী সম্পর্ক? লেখালেখি করা একটি রাজনৈতিক কাজ। মহৎ কোনো সাহিত্যই সমসময় থেকে আলাদা নয়। তাই এই সময়ে সাহিত্যকে আরও বেশি করে উদ্যাপন করা দরকার।
এই অনুষ্ঠানে আরও বক্তৃতা করেন সাহিত্যিক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম ও কায়সার হক। উৎসবে সবাইকে স্বাগত জানান আয়োজক সাদাফ সায্ সিদ্দিকী, আহসান আকবর ও কাজী আনিস আহমেদ। তাঁরা বলেন, উৎসবের উদ্দেশ্য দুটি। এক, বিশ্বসাহিত্যকে বাংলাদেশের কাছে নিয়ে আসা; এবং দুই, বাংলা সাহিত্যকে বিশ্বদরবারে তুলে ধরা। উৎসবের সহ-আয়োজক বাংলা একাডেমি, বিশেষ সহযোগী সংস্কৃতি-বিষয়ক মন্ত্রণালয়। সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূরের বক্তব্যের পর অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত উৎসবের উদ্বোধন ঘোষণা করেন।
পরের অধিশবেনে কাজী আনিস আহমেদের সঞ্চালনায় আলোচনায় অংশ নেন ভারতের ইতিহাসবিদ রামাচন্দ্র গুহ, ব্রিটিশ সাংবাদিক জন স্নো ও উইমেন অব দ্য ওয়ার্ল্ড ফেস্টিভ্যালের (ওয়াও) প্রতিষ্ঠাতা জুড কেলি। জুড কেলি বৈশ্বিকভাবে নারীর অবস্থান তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘এটা দেখা গেছে, যে সমাজ নারীশিক্ষার প্রতি যত বেশি যত্নবান, সে সমাজ তত বেশি শান্তিপূর্ণ।’ তাঁর কথার প্রসঙ্গে রামাচন্দ্র বলেন, ধর্ম, আইন ও সমাজের দৃষ্টিতে নারীর অবস্থান পুরুষের সমান না হলে সমাজে নারী-পুরুষের সাম্য আসবে না। এ ছাড়া তিনি বলেন, ভারতের যে ‘উন্নতি’ দেখা যাচ্ছে, তার একটি বিপরীত দিকও আছে। একটা বিশালসংখ্যক মানুষ এখনো শিক্ষার সুযোগ পায়নি, তাদের জন্য কোনো চাকরির ব্যবস্থা করা যায়নি। এরাই পরে মৌলবাদী গোষ্ঠীর হাতে চলে যাচ্ছে। ৩০ বছর আগেও যে নিরাপত্তাব্যবস্থা ছিল, এখন সেটি আর নেই। এরপর জন স্নো বলেন, এখন যে বিশ্ব তিনি দেখছেন, এমনটি দেখবেন কখনোই ভাবেননি। পশ্চিমা বিশ্বের তেলের যে ক্ষুধা, সেখান থেকে ধর্মীয় ও জাতিগত নানা সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ছে। তার উদাহরণ আফ–গানিস্তান, ইরাক ও সিরিয়া যুদ্ধ।
পরের অনুষ্ঠানে হিমাল সাউথএশিয়ান জার্নাল-এর বাংলাদেশ সংখ্যা প্রকাশিত হয়। জার্নালের সম্পাদক অনহিতা মজুমদারের সঞ্চালনায় কথা বলেন লেখক আফসান চৌধুরী, গার্গ চট্টোপাধ্যায়, প্রশান্ত ত্রিপুরা ও কাসিয়া পাপরোকি। আরেকটি অধিবেশনে মঞ্চের জীবন নিয়ে কথা বলেন আলী যাকের ও আসাদুজ্জামান নূর।
এ ছাড়া ছিল রবীন্দ্রনাথের নৃত্যধারা নিয়ে নৃত্যনন্দনের পরিবেশনা। নোবেলবিজয়ী হ্যারল্ড ভারমাস কথা বলেন বিজ্ঞানের উদ্দেশ্য, সম্ভাবনা ও রাজনীতি নিয়ে। একটি মজার অধিবেশন ছিল ফেসবুকের সাহিত্য নিয়ে।
আজ এবং আগামীকালও হবে এই উৎসব। সকাল নয়টা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত তিন দিনে এই উৎসবে অংশ নিচ্ছেন প্রায় ২৫০ জন শিল্পী, সাহিত্যিক, মানবাধিকারকর্মী ও সাংবাদিক। তাঁদের মধ্যে বাংলাদেশের বাইরের অংশগ্রহণকারী আছেন ৬০ জন; যাঁরা এসেছেন ১৪টি দেশ থেকে।