সুইয়ের ফোঁড়ে শূন্য থেকে সেরা

নারীদের সেলাইয়ের কাজ দেখিয়ে দিচ্ছেন সুমনা সুলতানা। সম্প্রতি পাবনার ভাঙ্গুড়া উপজেলার পাটুলিপাড়া গ্রামে।  ছবি: হাসান মাহমুদ
নারীদের সেলাইয়ের কাজ দেখিয়ে দিচ্ছেন সুমনা সুলতানা। সম্প্রতি পাবনার ভাঙ্গুড়া উপজেলার পাটুলিপাড়া গ্রামে। ছবি: হাসান মাহমুদ

পরিবারের অমতে বিয়েটা করেই আপনজনের আশ্রয় হারান। স্নাতকের পাট চোকেনি তখনো। স্বামী বেকার। এদিকে নিজের পড়ার খরচ, সংসারের খরচ—সব মিলিয়ে দিশেহারা অবস্থা। কী করবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না। বুদ্ধিটা তখনই আসে। মায়ের কাছে সেলাইয়ের কাজ শিখেছিলেন। সেটাই সম্বল করে সুই–সুতা হাতে তুলে নিলেন। ঘরে থাকা কাপড় দিয়ে বানালেন চারটি কুশন কাভার। জমা দিলেন আড়ংয়ে। দুটি কাভার মনোনীত হলো। পেলেন ৮০টি কুশন কাভার তৈরির অর্ডার। কিন্তু হাতে তো পুঁজি নেই। সাহায্যের হাত বাড়ালেন স্বামী মনোয়ার হোসেন। শখের কবুতর বেচে টাকাটা স্ত্রীর হাতে তুলে দিলেন। সেই টাকায় কুশন কাভার হলো। সময়মতো সেগুলো জমাও দিলেন। প্রথম মাসেই ৮০ হাজার টাকার কাজ পেলেন। দুজন কর্মী নিয়ে সেই কাজও তুলে দিলেন। পরের মাস থেকে হু হু করে কাজ আসতে থাকে।

এবার সঙ্গে আরও কয়েকজন নারীকে নিলেন। সুইয়ের এফোঁড়–ওফোঁড়ে রচিত হলো দিনবদলের অনন্য এক গল্প। যে গল্পের নায়িকা পাড়াগাঁয়ের সাদামাটা এক নারী। যিনি নিজের পাশাপাশি আরও অসংখ্য নারীর জীবন বদলে দিয়েছেন। ১৫ বছরে তিলে তিলে গড়ে তুলেছেন ৭০০ বুননশিল্পী। চলতি বছরই পেয়েছেন ‘বর্ষসেরা জাতীয় এসএমই ক্ষুদ্র নারী উদ্যোক্তা’র পুরস্কার। তিনি সুমনা সুলতানা (৩৭)। উদ্যমী এই নারীকে গ্রামের লোকেরা ‘সাথী আপা’ বলে ডাকেন। পাবনার ভাঙ্গুড়ার পাটুলিপাড়ার এই নারী গোটা জেলায় এখন একনামে পরিচিত।

পাটুলিপাড়ায় একদিন

সম্প্রতি সুমনার বাড়িতে গিয়ে নয়নাভিরাম সব কারুকাজ দেখা গেল। নারীরা কেউ বসেছেন উঠানে, কেউ ঘরের বারান্দায়, আবার কেউ মাদুর পেতে বসেছেন গাছের ছায়ায়। সবাই সুই–সুতা নিয়ে ব্যস্ত।

কথা হয় সুমনার সঙ্গে। তিনি জানালেন, পাটুলিপাড়া ছাড়াও পাবনা জেলা সদর, ভাঙ্গুড়া, ফরিদপুর ও চাটমোহর উপজেলার ১০-১২টি গ্রামে তাঁর কাজ চলছে। গ্রামের নারীদের দিয়ে কুশন কাভার, বিছানার চাদর, সোফার কাভার, নকশিকাঁথা, চাদর, পর্দা, টেবিল ক্লথ, কিডস ক্যারিয়ার, মেয়েদের কুর্তি, ছেলেদের ফতুয়া, পাঞ্জাবি ও শিশুদের নানা পোশাক তৈরি করছেন তিনি। আড়ংসহ খ্যাতনামা চারটি ফ্যাশন হাউসে তাঁর তৈরি পণ্য বিক্রি হচ্ছে। সুমনা বললেন, ‘অতীত না থাকলে ভবিষ্যৎ হয় না। আমি আমার অতীতকে স্মরণ করে ভবিষ্যতের দিকে হাঁটছি। শুরু থেকে মনোবল নিয়ে পরিশ্রম করেছি, পণ্যের গুণগত মান ঠিক রেখেছি, সময়ের মূল্য দিয়েছি। এখনো তাই করছি। আমার মনে হয় পুঁজি কিছু নয়। মনোবল, একাগ্রতা, সততা ও পরিশ্রম থাকলেই সফল হওয়া যায়।’

প্রথম মাসে কত টাকার কাজ করেছেন জানতে চাইলে সুমনা জানান, ৮০ হাজার টাকা। এরপর থেকে এক লাখ, দুই লাখ করে এখন কোনো কোনো মাসে ১২ লাখ থেকে ১৫ লাখ টাকার কাজও করছেন তিনি। কাজের পাশাপাশি নিজের পড়াটাও চালিয়ে গেছেন। পাবনা সরকারি এডওয়ার্ড কলেজে প্রাণিবিদ্যা থেকে স্নাতকোত্তর শেষ করেছেন।

আস্থা ও সুনাম

নিপুণ সেলাই আর সময়মতো পণ্য সরবরাহ করে ফ্যাশন হাউসগুলোর আস্থা ও সুনাম অর্জন করেছেন সুমনা। স্বামী-স্ত্রী মিলে ব্যবসা দেখভাল করেন। এই কাজ দিয়েই স্বামীর বসতভিটায় দোতলা বাড়ি করেছেন। নিচতলায় দিয়েছেন কারখানা। নাম দিয়েছেন ‘এসআর হ্যান্ডিক্র্যাফটস’। পাশাপাশি পাবনা শহরের রাধানগর মহল্লায় করেছেন আরেকটি কারখানা। গ্রাম থেকে নকশার কাজ শেষে কারখানায় চলে যায় কাপড়। সেখানে সেলাই, ধোয়া ও ইস্তিরির কাজ চলে। দুই কারখানায় সেলাই মেশিনসহ ২০টির মতো নানা ধরনের যন্ত্র আছে সুমনার।

সুমনার নারী কর্মীদের দলনেতা তহমিনা খাতুন জানালেন, তাঁদের গ্রাম চিথুলিয়ায় ৬০ জন নারী কর্মী নিয়ে সাথী আপা একটি দল তৈরি করে দিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে অনেকে গৃহবধূ, অনেকে পড়াশোনা করেন। সংসার-পড়ালেখার পাশাপাশি তাঁরা সেলাই করেন। এতে একদিকে তাঁদের অবসর সময় কাটে, অন্যদিকে রোজগার হয়। প্রতি মাসে এসব নারী গড়ে আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা আয় করেন। অনেকের আয় আরও বেশি।

আঁখি খাতুন নামে সপ্তম শ্রেণির এক শিক্ষার্থী বলে, ‘আপার কাছে প্রশিক্ষণ নিয়ে কাজ করছি। এখন আর নিজির ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবিনে। পড়ালেখা শেষ করে আপার মতো উদ্যোক্তা হব।’

অন্যরা যা বলেন

সুমনার উদ্যোগ নিয়ে ভাঙ্গুড়া পৌরসভার মেয়র গোলাম হাসনায়েন বলেন, ‘সাথী আপা’ এখন স্থানীয়দের কাছে জনপ্রিয় একটি নাম। তিনি শ্রম, মেধা, মনোবল দিয়ে নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছেন। অন্যদেরও স্বাবলম্বী হতে উৎসাহিত করছেন।

পাবনা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি সাইফুল আলম চৌধুরী বলেন, সুমনা শুধু নিজে কাজ করছেন না, নতুন নতুন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা তৈরি করতে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে প্রশিক্ষণও দিচ্ছেন। বেকার যুব নারী-পুরুষদের উৎসাহ জোগাচ্ছেন। নিজে স্বাবলম্বী হওয়ার পাশাপাশি বহু নারীকে স্বাবলম্বী করেছেন। বর্ষসেরা এসএমই ক্ষুদ্র নারী উদ্যোক্তার পুরস্কার জিতে পুরো জেলার সম্মান বয়ে এনেছেন।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সুমনা বলেন, ‘জেলার প্রতিটি গ্রামের বেকার নারীকে কাজের মাধ্যমে স্বাবলম্বী করতে চাই। এ কাজের সঙ্গে আরও বেশি মানুষকে সম্পৃক্ত করতে এসআর হ্যান্ডিক্রাফটসের একটি শোরুম দেওয়ার স্বপ্ন দেখি।’